
‘আমি সব সময় চেয়েছিলাম আমার ছেলে বড় হয়ে একজন ভালো আলেম হবে। কিন্তু ফ্যাসিস্টের একটি গুলি আমার সমস্ত স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিল।’
কথাগুলো বলছিলেন, ১৮ বছর বয়সী কওমি মাদ্রাসার ছাত্র মো. জিহাদ হোসেনের বাবা মো. মোশাররফ হোসেন।
৫ আগস্ট জিহাদ বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন ঐতিহাসিক ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে। এটি ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা শেষ পর্যন্ত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়েছিল।
এই আন্দোলন যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখনই জিহাদ নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর লড়াইয়ে শহীদ হন।
তার ৬৫ বছর বয়সী বাবা মো. মোশাররফ হোসেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর বিবিরবাগিচা এলাকায় একটি ছোট খাবারের দোকান চালান। সম্প্রতি বাসস-এর সঙ্গে একান্ত আলাপে সেই মর্মান্তিক দিনের কথা তুলে ধরেন তিনি।
পুত্রশোকে কাতর বাবা ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘জিহাদ দুপুর ১২টায় বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তার মা পারভিন আক্তার (৪৭)-কে কথা দিয়েছিল যে, আন্দোলন শেষে দুপুরের খাবারের জন্য ফিরে আসবে।’
স্বৈরাচারী শাসনের পতনের পর শেখ হাসিনা ও তার বোন দেশত্যাগে বাধ্য হলে রাজধানীসহ সারা দেশে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। যাত্রাবাড়ী এলাকায়ও হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে উল্লাস করে।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরই যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে সেই উল্লাস ভয়াবহ আতঙ্কে পরিণত হয়। পুলিশের নির্বিচার গুলিতে সেদিন অসংখ্য প্রাণ ঝরে যায়। জিহাদ তাদেরই একজন।
সেদিনের একটি ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশের দল থানা থেকে বের হয়ে নির্মমভাবে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাচ্ছে, আর রাস্তাজুড়ে পড়ে আছে লাশের স্তূপ।
মোশাররফ বলেন, ‘আমি নিজেও ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম। থানার পশ্চিম পাশে অবস্থান করছিলাম, তখন আমি নিজেই পাঁচটি মৃতদেহ রিকশাভ্যানে করে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলাম।’
‘আমি যখন মৃতদেহ হাসপাতালে নেওয়ার কাজে ব্যস্ত, তখন বিকেল ৫টার দিকে আমার শ্যালিকার একটি ফোন পাই,’ স্মৃতিচারণ করেন মোশাররফ। ফোনকলেই তিনি জানতে পারেন, জিহাদ গুলিবিদ্ধ হয়েছে এবং তাকে শনির আখড়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দৃশ্যের বর্ণনা দিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকেল ৪টার দিকে যাত্রাবাড়ী থানার পূর্ব পাশে পুলিশ গুলি চালায়, তখনই জিহাদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। একটি গুলি তার বাম বুকে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়।
‘আমার ছেলে যখন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, তখন কিছু ছাত্র তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর ছাত্ররা জিহাদের মরদেহ আমাদের বিবিরবাগিচার বাসায় নিয়ে আসে, ’শোকাতুর কণ্ঠে বলেন মোশাররফ।
পরের দিন ৬ আগস্ট জিহাদের মরদেহ বরিশালের মুলাদী উপজেলায় তাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
জিহাদ ছিল চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয়। তার বড় ভাই মো. রিয়াদ হোসেন বাবার সঙ্গে খাবারের দোকানে কাজ করেন। তার বোন সাবিকুন্নাহার বিবাহিত। আর ছোট বোন সামিয়া নবম শ্রেণির ছাত্রী।
আন্দোলনের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে মোশাররফ বলেন, ‘১৭ জুলাই থেকে যখন এই আন্দোলন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পরিণত হয়,তখন থেকেই আমরা নিয়মিত অংশ নিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘১৯ জুলাই আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা আমার ছেলেদের মারধর করে এবং আমার দোকান ভাঙচুর করে। তখনই আমি আমার ছেলেদের বলে দিই, তারা যেন রাজপথ ছেড়ে না আসে যতক্ষণ না এই ফ্যাসিবাদী সরকার পতন হয়।’
নিজের কষ্ট প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘জিহাদ শুধু আমার ছেলে ছিল না, সে আমাদের পরিবারের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিল। পড়াশোনার পাশাপাশি খাবারের দোকানের কাজে আমাকে সাহায্য করত।’
‘একজন বাবার জন্য সবচেয়ে ভারী বোঝা হলো নিজের সন্তানের লাশ কাঁধে বহন করা। জানি না, আমরা কীভাবে বাকি জীবন কাটাব, ’ বলেন শোকাহত মোশাররফ।
ছাত্রদের নেতৃত্বে সংঘটিত এই গণঅভ্যুত্থানে বহু মানুষ হতাহত হয়েছেন উল্লেখ করে মোশাররফ জিহাদসহ সব শহীদের জন্য ন্যায়বিচার দাবি করেন।
তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং আসাদুজ্জামান খান কামালকে এই হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী করেন।
‘শেখ হাসিনার নির্দেশেই পুলিশ আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। আমি চাই সরকার দোষীদের বিচারের আওতায় আনুক। আমি আমার জীবদ্দশায় হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড দেখে যেতে চাই,’ বলেন মোশাররফ। সূত্র: বাসস