Image description

জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধান শেখ হাসিনাসহ ১৪১ জনের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা (ওয়ারেন্ট) জারি করা হয়েছে। ২৩টি তদন্তাধীন মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এসব পরোয়ানা জারি করেছেন। এসব আসামির মধ্যে রাজনীতিবিদ, বিচারক ও আমলার সংখ্যা ৭২ জন। ওয়ারেন্টভুক্ত বাকি আসামিদের মধ্যে পুলিশের সংখ্যা ৬২ এবং ৯ জন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ও বরখাস্তকৃত কর্মকর্তা রয়েছেন।

পরোয়ানাভুক্ত আসামিদের মধ্যে বেশিরভাগই পলাতক। পরোয়ানা জারির পর ৫১ জনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলেও বাকি ৯০ আসামি এখনো পলাতক। পলাতকদের মধ্যে শেখ হাসিনা ও সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে তিনটি করে এবং শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা তারেক আহম্মেদ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে দুটি করে পরোয়ানা জারি হয়েছে। বেশিরভাগ আসামি পলাতক থাকায় ক্ষুব্ধ মামলার বাদীপক্ষ। এমনকি আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ায় অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালও।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল থেকে ওয়ারেন্ট জারির পর তা কার্যকর করার জন্য পুলিশ সদর দপ্তর ও পুলিশ মহাপরিদর্শক বরাবর পাঠানো হয়। কিন্তু পুলিশ অধিকাংশ ওয়ারেন্ট কার্যকর করেনি। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবহেলার অভিযোগ তুলেছেন ভুক্তভোগীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী ওয়ারেন্ট জারির পরই কেবল একজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা যায়। কিন্তু ওয়ারেন্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অনেক আসামি খবর পেয়ে আত্মগোপনে চলে যাচ্ছেন। আবার অনেক ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি প্রকাশ্যে ঘোরাঘুরি করলেও তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযুক্তদের ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় আসামিকে আগেই গ্রেপ্তার দেখিয়ে পরে ট্রাইব্যুনাল থেকে ওয়ারেন্ট জারির সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালন করছে। এমনকি সরকারের দায়িত্বশীলরাও এই বিচার নিয়ে অনেকটাই ‘কচ্ছপ’ গতিতে এগোচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

 

আসামি না ধরায় জুলাই আন্দোলনে যাত্রাবাড়ীতে নিহত ইমাম হাসান তাইম হত্যা মামলার বাদী রবিউল আউয়াল ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের কাছে গত ৩০ জানুয়ারি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। ইমাম হাসান তাইম নারায়ণগঞ্জের সরকারি আদমজীনগর এম ডব্লিউ কলেজের দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়তেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ২০ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন। তার বাবা রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. ময়নাল হোসেন ভূঁইয়া। এ মামলায় বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি আছে।

 
 

রবিউলের আবেদনে বলা হয়, গত ১২ নভেম্বর ডিআইজি অপারেশন মো. রেজাকে আসামিদের সন্ধানের তথ্য জানিয়ে গ্রেপ্তারের অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। তারপর ১৪ নভেম্বর তিনি আসামিদের মোবাইলে ফোন দিয়ে তাদের সঙ্গে কথাও বলেন। সঙ্গে সঙ্গে ডিআইজি অপারেশনকে সেই কথা জানিয়েও কাজ হয়নি বলে আবেদনে উল্লেখ করেন। আসামিদের গ্রেপ্তার না করে ‘স্বজনপ্রীতি’ দেখানোর অভিযোগ তুলে প্রসিকিউশনের কাছে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয় ওই আবেদনে।

 

গত ৩০ জানুয়ারি এই হত্যা মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য ছিল। ওইদিন শুনানিতে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এ মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত চার আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ার বিষয়ে প্রসিকিউশনের কাছে জানতে চান। এ সময় প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ ট্রাইব্যুনালকে জানান, এ মামলার বাদী আমাদের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন। পরোয়ানা জারির পর আসামিদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে পুলিশের বিভিন্ন সংস্থার কাছে গিয়েও তিনি সহযোগিতা পাননি। এ বক্তব্য শুনে ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে বলেন। এ সময় দুই মাস সময় দিয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছিলেন, যদি এ সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল ও আসামি গ্রেপ্তার না হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ব্যাখ্যা দিতে বলেন। কিন্তু এর পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নড়েচড়ে বসেনি।

জানতে চাওয়া হলে ইমাম হাসান তাইমের ভাই রবিউল আউয়াল গতকাল কালবেলাকে বলেন, ‘আসামি গ্রেপ্তারের জন্য বারবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ধরনা দিয়েছি। গত পরশু পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে গিয়েছি। আইজিপি বলেছেন, তাগাদা দিচ্ছেন কেন? ঘটনার আট মাস পর এসেও অধিকাংশ আসামি ধরে নাই, আর এটা বললেও তাগাদা হলো?’ তিনি বলেন, ‘আসামিদের না ধরে তারা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করছেন। যে শহীদদের রক্তের ওপর দিয়ে এসে আজ তারা চেয়ারে বসেছেন, সেই শহীদদের হত্যাকারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের ধরা হচ্ছে না। এটা স্বজনপ্রীতি আর দায়িত্বে অবহেলা ছাড়া কিছুই না। তিনি আরও বলেন, বিচারের নামে প্রহসন চলছে। আসামিদের না ধরে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করছেন। আসামি না ধরলে কাদের ফাঁসি দেওয়া হবে? জুলাই শহীদদের বিচার হবে—এটা কীভাবে বুঝব? বিচারের সন্তোষজনক অগ্রগতি না হলে খুব শিগগির তারা রাজপথে নামবেন। জানতে চাওয়া হলে চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ওয়ারেন্ট জারির পর তা আইজিপির কাছে পাঠাই। আসামি ধরার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।’ আর তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ ছাড়া চেষ্টা করেও এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরের কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

‘পলাতক ৯০ আসামি’

গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রায় আড়াই মাস পর ১৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। গণঅভ্যুত্থান ও আওয়ামী লীগ শাসনামলে সংঘটিত গুম, খুন, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে এই ট্রাইব্যুনালে। যদিও এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য।

ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয় সূত্র বলছে, গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যা ও গণহত্যা এবং আওয়ামী লীগের বিগত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এ পর্যন্ত সাড়ে তিনশর মতো অভিযোগ এসেছে। এসব অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে ট্রাইব্যুনালে এখন পর্যন্ত ২৩টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৩টি মামলা হয়েছে গুমের ঘটনায়, একটি মামলা হয়েছে শাপলা চত্বরে গণহত্যার অভিযোগে। বাকি ১৯টি মামলা হয়েছে গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে। এসব মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়া ১৪১ জনের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৯০ জন পলাতক রয়েছেন। গ্রেপ্তারের সুবিধার্থে পলাতক আসামিদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করেনি ট্রাইব্যুনাল। তবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত বেশ কিছু আসামি এরই মধ্যে পালিয়ে গেছে বলে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যায়।

তাদের মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হওয়া তিনটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন ট্রাইব্যুনাল। ভারতে অবস্থান করা হাসিনাকে গ্রেপ্তারের জন্য আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে রেড অ্যালার্ট জারি করতে অনুরোধ জানিয়েছে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়। পাশাপাশি তাকে ফেরত চেয়ে ভারতের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে সরকার। কিন্তু তাকে ফেরানোর ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি নেই। এ ছাড়া পলাতক আসামিদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ, সাবেক সামরিক উপদেষ্টা তারেক আাহমেদ সিদ্দিক অন্যতম। পলাতক আসামিদের মধ্যে বেশিরভাগই রাজনীতিবিদ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য।

‘গ্রেপ্তার ৫১’

এখন পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের মামলায় যে ৫১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ১৪ জন সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাসহ ২২ জন রাজনীতিবিদ রয়েছেন। তারা হলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, আমির হোসেন আমু, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান, সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, সাবেক পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক শাহিনুর মিয়া, উত্তরা পশ্চিম থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মনোয়ার ইসলাম চৌধুরী, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন মণ্ডল, উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টর আওয়ামী লীগের সভাপতি বশির উদ্দিন, মহানগর উত্তরের এক নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন রুবেল, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শরিফুল ইসলাম ও রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক মো. ইমরান চৌধুরী আকাশ।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাবেক ২৭ জন সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছেন। তারা হলেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক, সাবেক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, র্যাব-২-এর সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) মহিউদ্দিন ফারুকী, জসিম উদ্দিন মোল্লা (ডিসি-মিরপুর), আবদুল্লাহিল কাফী (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সাভার), সাবেক এডিসি এম এম মইনুল ইসলাম, আলেপ উদ্দিন (সাবেক র্যাব কর্মকর্তা), সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহিদুল ইসলাম, সাবেক এসি তানজিল আহমেদ, সাবেক ওসি আবুল হাসান, সাবেক ওসি মো. মাজহারুল ইসলাম, সাবেক ডিবি পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন, সাবেক ওসি (তদন্ত) মোহাম্মদ আরশাদ হোসেন, এসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকার, কনস্টেবল মোহাম্মদ সুজন হোসেন, কনস্টেবল মুকুল চোকদার, কনস্টেবল হোসেন আলী ও আকরাম, এসআই আব্দুল মালেক, সাবেক ওসি মজিবুর রহমান, এসি জাবেদ ইকবাল, এসি রাজন কুমার সাহা, এসআই আমির হোসেন, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় ও নায়েক সোহেল মিয়া। এ ছাড়া গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব জাহাংগীর আলম।