Image description

আমরা জুলাইয়ের অনুপ্রেরণায় নতুন একটা ইনসাফের বাংলাদেশ গড়তে চাই। এজন্য যে সংগ্রাম দরকার আপামর জনসাধারণকে নিয়ে সেটি করব।

জুলাই বিপ্লবের অন্যতম যোদ্ধা এবং ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি আমার দেশের ব্যবস্থাপনা সম্পাদককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিচার, সংগঠনটির যাত্রা, জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশ নিয়ে তার স্বপ্ন, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, হিন্দুত্ববাদ, নতুন দল এনসিপিতে না যাওয়াসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন তিনি।

ইনকিলাব মঞ্চের যাত্রা কীভাবে জানতে চাওয়া হয় হাদির কাছে। জবাবে তিনি বলেন, ইনকিলাব মঞ্চ জুলাই অভ্যুত্থান অনুপ্রাণিত একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। জুলাইয়ের চেতনাকে বাঁচানোর জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা ১৩ আগস্ট রাজপথে দাঁড়াই ইনকিলাব মঞ্চের ব্যানারে। সেদিন শাহবাগে আমাদের দাবি ছিল দুটি। সেগুলো হলো— এক. জুলাই গণহত্যা এবং আওয়ামী লীগের বিচার করতে হবে। দুই. আওয়ামী লীগকে নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে। এই দাবিগুলো নিয়ে আমরা সেদিন সকালে শাহবাগে দাঁড়িয়েছিলাম ১০ জনের মতো। তিন-চার ঘণ্টা পর আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয় শত শত মানুষ। সেদিন ইনকিলাব মঞ্চের প্রাথমিক যাত্রা। আমাদের প্রথম যাত্রাটাই শাহবাগে এবং রাজপথের মধ্য দিয়ে।

ইনকিলাব মঞ্চের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে মুখপাত্র বলেন, আমরা ইনকিলাব মঞ্চকে একটি প্রেশার গ্রুপ হিসেবে রাখতে চাই। একটা ইনসাফের বাংলাদেশ আমরা নির্মাণ করতে চাই। এজন্য যে সংগ্রাম দরকার আপামর জনসাধারণকে নিয়ে সেটি করতে চাই। পাশাপাশি সব রাজনৈতিক দলকে জুলাইয়ে ফেরাতে চাই।

জুলাই শহীদদের নিয়ে রাষ্ট্রের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে হাদি বলেন, প্রায় দুই হাজার শহীদ, তাদের পরিবারের কাকে রাষ্ট্র কত টাকা দিতে পারল? আমরা কি সে তথ্য সবাই দেখতে পারি? এ বিষয়ে কি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো ওয়েবসাইট আছে? আমরা তো এ বিষয়ে কোনো তথ্যই জানতে পারি না। এর অর্থ হচ্ছে আমরা তো ইনসাফ করতে পারিনি। রাষ্ট্র যদি ওয়েবসাইটে এ বিষয়গুলো দিতে পারে, তাহলে যারা বঞ্চিত হবে তাদের বিষয়ে আমরা উদ্যোগ নিতে পারব। এর তো একটা ডাটাবেজ থাকা দরকার।

নতুন দলে না যাওয়া প্রসঙ্গে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র বলেন, আমার চূড়ান্তভাবে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ হচ্ছে—শুনলাম, নাগরিক কমিটির কিছু ভাই-বন্ধু, তাদের বিরুদ্ধে আগেও করাপশনের অভিযোগ ছিল। কিন্তু আমি পাত্তা দিইনি। কিন্তু যখন দেখলাম, খুবই নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে কারো কারো দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে, তখন ইনকিলাব মঞ্চের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল তারা আমাকে নতুন দলে যেতে দেবে না।

তবে এনসিপিকে সফল হতেই হবে বলে উল্লেখ করেন হাদি। তিনি বলেন, এনসিপি তো মাত্র শুরু হলো। দলটির নানা সমালোচনা করব। এরপরও আমি বলব এনসিপিকে সফল হতে হবে। কারণ জুলাইকেন্দ্রিক একটা দল যদি সফল না হয়, তাহলে বাংলাদেশ শেষ।

এপ্রিলে আসতে যাওয়া নতুন দলের প্রতি শুভকামনা জানিয়ে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র বলেন, এটাও নাগরিক কমিটির ভাইয়েরা উদ্যোগ নিচ্ছেন। এর জন্য আমি শুভ কামনা জানাই। সবচেয়ে ভালো হতো জুলাই পক্ষের সবাই মিলে একটি দল করতে পারলে।

আওয়ামী লীগ ও শাহবাগ প্রশ্নে কঠোর হওয়া প্রসঙ্গে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র বলেন, শাহবাগ হলো বাংলাদেশের সেই জিনিস যেটা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে পুরোপুরি ধ্বংস করে এখানে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে। শাহবাগের বিষয়ে আমাদের স্পষ্ট কথা হলো— এই শাহবাগ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বিচার কাঠামো, প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙেচুরে দিল্লির প্রেসক্রিপশনে বিদেশি অর্থ সহায়তায় রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র, পৃথিবীর নিকৃষ্টতম মব তৈরি করেছিল। যে মবের কারণে বিচার চাই না ফাঁসি চাই— এই যে রাষ্ট্রদ্রোহের কথা এখানে বলা হয়েছে। এখানে তিন স্তরের নিরাপত্তা নিয়ে কাচ্চি খেয়ে, বিরিয়ানি খেয়ে, ইন্টারকন্টিনেন্টালে ঘুমিয়ে তারপর এসে নেতারা ঘোষণা দিয়েছে, আজ পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। একমাত্র রাষ্ট্র ছাড়া এটা বলার ক্ষমতা কারো নেই। সঙ্গে সঙ্গে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় গ্রেপ্তার করার কথা ছিল। কিন্তু করা হয়নি।

শাহবাগ না হলে আরেকটা শাপলা হতো না বলে জানান ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র। তিনি বলেন, এই শাহবাগের প্রতিক্রিয়ায় শাপলা হয়েছে। সেই শাপলায় ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা হাসিনা চালিয়েছে। আমরা বলেছি, এই শাপলা গণহত্যা করেছে শাহবাগ। সেই শাপলা থেকে হাসিনা শিখেছে মানুষ মেরে লাশ গুম করে দেওয়া যায়, কিচ্ছু হয় না, পার পাওয়া যায়। সেই কারণ পরবর্তী সময়ে হাসিনা আয়নাঘর করেছে, গুম করেছে, খুন করেছে; এমন কোনো ভয়াবহ অপরাধ নেই যা সে করেনি। এ জুলাইয়েও সে একই কাজ করেছে। জুলাইয়ে যে লাশটা আধাঘণ্টা হয়নি মারা গেছে, সেই লাশকেও আশুলিয়ায় পুড়িয়ে ফেলেছে, হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে অসংখ্য মানুষকে মারা হয়েছে। এসব গণহত্যার ন্যারেটিভ নির্মাণ, তার বৈধতা কে করেছে? এই শাহবাগ করেছে। তার মিডিয়া দিয়ে, তার কালচারাল এলিট দিয়ে। কালচারাল এলিট কারা? যারা দিনের পর দিন নাটক, সিনেমায়, গল্পে, উপন্যাসে তুলে ধরেছে হাসিনার বিকল্প আর কেউ নেই। খালেদা জিয়াকে এই শাহবাগ অসুর সাজিয়েছে।

শাহবাগের অর্থ কোথা থেকে এসেছে, তা তদন্তে কমিটি গঠনের দাবি জানান হাদি। তিনি বলেন, শাহবাগ বলেছে ফাঁসি চাই, আমরা বলেছি বিচার চাই। এটা কি একটা ইনসাফ না যে, আপনি একটা তদন্ত কমিশন করবেন শাহবাগের ব্যাপারে। তদন্ত কমিশন বলবে, এখানে শত শত কোটি টাকা কারা ফান্ডিং করেছে। কোন দেশ থেকে মদত দেওয়া হয়েছে। এটা যদি আমি বলি, এটা কি কাউকে ট্যাগ দেওয়া?

হিন্দুত্ববাদ প্রসঙ্গে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র বলেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে হিন্দুত্ববাদ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন মানি না। হিন্দু আর হিন্দুত্ববাদ কিন্তু এক নয়। বাংলাদেশের অগণিত মুসলমান হিন্দুত্ববাদী। সে দিল্লির দূতাবাসের টাকা খেয়ে, ‘র’-এর টাকা খেয়ে বিভিন্ন এজেন্সির সঙ্গে সে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিটা এখানে করে। এখানে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের মানে হলো দিল্লির আগ্রাসন।

আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা প্রসঙ্গে হাদি বলেন, আমি যতদূর জেনেছি বহির্বিশ্ব থেকে চাপ আছে যে, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে দিতে হবে। হয়তো এটা গুড আওয়ামী লীগ। নইলে ইনক্লুসিভ ইলেকশন হবে না। আমি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে বলতে চাই, আপনার বৈশ্বিক শক্তিকে প্রশ্ন করুন, গত ১৫ বছর এ ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ কায়েম করতে পেরেছিল তোমাদের জন্য। এখন আজ তোমরা তাদের কীভাবে নির্বাচনে আনতে চাও। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এলে আমার আপত্তি নেই। জুলাই, শাপলা, পিলখানা— প্রত্যেকটা গণহত্যার শতভাগ বিচার নিশ্চিত করে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনুন আমার তাতে আপত্তি নেই। কারণ ৩০০ আসনে তখন নির্বাচন করার মতো আওয়ামী লীগই তো তখন আপনি খুঁজে পাবেন না।

সংস্কার প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র বলেন, আমূল সংস্কার চাই। আমার মতে, সবার আগে সংস্কারটা শুরু হবে বিচারের মধ্য দিয়ে। বিচার হতে হবে। জুলাইয়ের দৃশ্যমান বিচার না করে নির্বাচনের দিকে যাচ্ছেন এটা তো রক্তের সঙ্গে গাদ্দারি।

জুলাই যোদ্ধাদের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে হাদি বলেন, আমাদের সবাইকে এক রাখতে পারবে আওয়ামী লীগ ও হাসিনা। সে আসবে বললে আমরা যত ঝগড়া করেছি, সব ঝগড়া ভুলে সবাই মিলে রাজপথে দাঁড়িয়ে ইনশাআল্লাহ আওয়ামী সন্ত্রাস, দিল্লির আগ্রাসন রুখে দেব। বাংলাদেশ প্রশ্নে সবাই এক ছিলাম, আছি ও থাকব, ইনশাআল্লাহ।