
ডায়াবেটিস বা হৃদরোগের মতো দীর্ঘমেয়াদি ও অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি কমাতে সরকারের অন্যতম উদ্যোগ হচ্ছে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ ( এনসিডিসি ) কর্মসূচি । এর অধীনে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এনসিডি কর্নারের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের জনসাধারণকে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস - বিষয়ক বিভিন্ন জরুরি সেবা দেওয়া হয় । তবে সরকারের ৫ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা ( অপারেশনাল প্ল্যান বা ওপি ) কার্যকর না থাকায় আট মাস ধরে এনসিডি কর্নারের কার্যক্রমে স্থবিরতা চলছে । আগামী মাসে ওষুধের বড় ধরনের সংকটের আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে । দেশের স্বাস্থ্য খাতের সিংহভাগ অবকাঠামো , প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ,
হাসপাতালের সেবা ব্যবস্থাপনা , সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং টিকা , পুষ্টি কার্যক্রমসহ ৩০ টির বেশি কর্মসূচি পরিচালিত হয় পাঁচ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা বা মেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা বা ওপির মাধ্যমে । সর্বশেষ ওপি ‘ চতুর্থ স্বাস্থ্য , জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি ( এইচপিএনএসপি ) ' শেষ হয় গত বছরের জুনে । ওই বছরের জুলাই
মাসেই পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য ১ লাখ ৬ হাজার ১০০ কোটি টাকার পঞ্চম এইচপিএনএসপি শুরু হওয়ার কথা ছিল । কিন্তু তা অনুমোদন করেনি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার । তবে এখন ওপি থেকে বের হওয়ার কথাই ভাবছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ । নতুন সেক্টর কর্মসূচি না নিয়ে স্বাস্থ্যবিষয়ক কার্যক্রমগুলো রাজস্ব খাতে নেওয়ার
পরিকল্পনা করা হচ্ছে । এর সময় ধরা হয়েছে গত বছরের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত । পরিকল্পনা কমিশনও সেক্টর কর্মসূচির বিকল্প ভাবার পরামর্শ দিয়েছে । প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার স্তরে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মডেল বাস্তবায়ন করা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য । ২০১৮ সালের অক্টোবরে দেশের মধ্যে প্রথম সিলেটের চারটি উপজেলায় এনসিডি কর্নার চালু করা হয় । এতে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস শনাক্ত , চিকিৎসা ও রোগ নিয়ন্ত্রণ , ওষুধ বিতরণ ও রোগীদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয় । রোগীদের নিবন্ধন করে নিয়মিত ফলোআপ করা হয় । দেশের ৪২৯ টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ১০ টি জেলা হাসপাতালে এই
উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের স্বাস্থ্যসেবা
কর্নার রয়েছে । এনএইচএফবি , জাইকা , আইসিডিডিআর , বি , ব্র্যাক হেলথসহ আটটি প্রতিষ্ঠান কর্নারগুলো স্থাপনে সরকারকে কারিগরি সহায়তা দিয়েছে । পাশাপাশি এগুলো স্থাপন এবং যন্ত্রপাতি ও ওষুধের খরচ চালানো হয় ওপির টাকায় । বর্তমানে ওপি না থাকায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে । এ পর্যন্ত নিবন্ধিত ১০ লাখ রোগী এখন চাহিদামতো ওষুধ পাচ্ছে না । এপ্রিল মাসে সংকট ভয়াবহ পর্যায়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা । নিবন্ধিত রোগীদের চিকিৎসা , ফলোআপ এবং ওষুধ পাওয়ার জন্য একটি ‘ সবুজ বই ’ দেওয়া হয় , যা ছাপার কাজ অর্থাভাবে বন্ধ রয়েছে । ইতিমধ্যেই রক্তের শর্করা পরিমাপের গ্লুকোমিটার স্ট্রিপের বেশ অভাব দেখা দিয়েছে ।
অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি সূত্রে জানা যায় , এনসিডি কর্নারে মূলত ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের জন্য মেটফরমিন ও গ্লিক্লাজাইড , উচ্চ রক্তচাপের জন্য অ্যামলোডিপিন , লোজারটেন হাইড্রোক্লোরোথায়াজাইড ইত্যাদি ওষুধ দেওয়া হয় । এ ছাড়া হৃদরোগীরা পান অ্যাসপিরিন ও রোজুভাসটেটিন । ওষুধগুলো সুলভ ও সহজলভ্য হলেও ওপি বন্ধ থাকায় তা নতুন করে কেনা হচ্ছে না । অথচ কর্নারে প্রতি মাসে নতুন করে ৬ থেকে ৭ হাজার রোগীর নিবন্ধিত হচ্ছে । ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো স্বাস্থ্যসমস্যার রোগীদের নিয়মিত
ওষুধ গ্রহণ ও চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে থাকতে হয় । যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের তথ্যমতে , এ অসুখ দুটি হৃদরোগ , কিডনি , স্নায়বিক সমস্যা , ক্যানসারসহ বিভিন্ন অসংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি বাড়ায় । আবার ডায়াবেটিস রোগীদের উচ্চ রক্তচাপ অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ । ডায়াবেটিসে অসুস্থতা ও মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো হৃদরোগ । এই ঝুঁকি উচ্চ রক্তচাপের কারণে আরও বেড়ে যায় । বাংলাদেশ সরকারের সর্বশেষ স্বাস্থ্য বুলেটিন বলছে , দেশে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ধীরে ধীরে কমলেও বাড়ছে অসংক্রামক ব্যাধি । রোগে মৃত্যুর ৭০ শতাংশই হচ্ছে অসংক্রামক রোগের কারণে । সব মিলিয়ে মোট মৃত্যুর ৩৪ শতাংশ হৃদরোগ এবং ৪ শতাংশ ডায়াবেটিসের কারণে হচ্ছে । মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রয়েছে একটি এনসিডি কর্নার । উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা . জামসেদ ফরিদী আজকের পত্রিকাকে জানিয়েছেন , এ কর্নারে এখন পর্যন্ত ওষুধের সংকট দেখা যায়নি । তবে তারা হিসাব করে ওষুধ খরচ করছেন । অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির একজন কর্মকর্তা বলেছেন , ওপি ছাড়া কার্যক্রম কীভাবে চলবে সরকারকে তা ৩১ মার্চের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে । স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সে অনুযায়ী কর্মসূচির পরিকল্পনা করছে । উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার
কল্যাণ কর্মকর্তাদের এনসিডি কর্নার চালু রাখার দায়িত্ব দিয়ে প্রতি বছর নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হতে পারে । ওপি না থাকলেও কর্নারের কার্যক্রম যাতে চলমান থাকে তা ভাবা হচ্ছে । তবে এতে কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা আর থাকবে না । উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপক ডা . রাহাত ইকবাল চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন , এ বছর থেকে জেলা হাসপাতাল এবং পরবর্তী সময়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতেও এনসিডি কর্নার চালুর কথা ছিল । এখন ওপি না থাকায় কর্নারগুলো আর হচ্ছে না । বই বিতরণ , যন্ত্রাংশ , ওষুধের সংকট রয়েছে । আমরা চেষ্টা করছি যেন এনসিডির কাজ থেমে না যায় । উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অর্গানোগ্রামে এটি রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে । ' এনসিডি কর্নারের গুরুত্ব তুলে ধরে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা . সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন , ‘ এনসিডি কর্নারের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষকে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি থেকে বাঁচানো গেছে । বিশেষ করে দরিদ্রদের । কর্নারে শুরুতে যাঁরা চিকিৎসার জন্য আসতেন , তাঁদের বেশির ভাগই প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ । ওপি না থাকার কারণে এনসিডির কাজ থেমে গেলে তা হবে চরম ব্যর্থতা । ’ স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো . সাইদুর রহমান বলেন , ‘ ওপি না থাকলে যেন কোনো কার্যক্রমই বন্ধ না হয় সে বিষয়ে আমরা পরিকল্পনা করছি । ”