
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। আসছে জুনে এটি উপস্থাপন করা হবে। প্রায় প্রতি বছরই বাজেট ঘোষণার আগে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়। অর্থনীতিবিদ, কর বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ করদাতারা একে অনৈতিক ও বৈষম্যমূলক বলে অভিহিত করেন। তা সত্ত্বেও প্রায় প্রতি বছরই যখন বাজেট পাস হয় তখন দেখা যায় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয় সরকার। এতে নির্দিষ্ট হারে কর পরিশোধের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত আয়কে বৈধ করা যায়। অর্থনীতিবিদদের কেউ একে রাজস্ব বাড়ানোর কৌশল বলছেন, আবার কেউ বলছেন সৎ করদাতাদের প্রতি অবিচার।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সরকার ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছিল। তবে, আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এই সুবিধা বাতিল করে। এই সিদ্ধান্তের ফলে কালো টাকা সাদা করতে হলে এখন প্রযোজ্য সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ কর এবং তার ওপর ১০ শতাংশ জরিমানা দিতে হবে। কালো টাকা সাদা করার এই সুবিধা বাতিলের পেছনে বিভিন্ন মহলের সমালোচনা ভূমিকা রেখেছে। আগামী বাজেটেও কি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকবে?
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেছেন, ‘আসন্ন বাজেটে কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা বাতিলের চেষ্টা করা হবে।’
শনিবার (২২ মার্চ) ঢাকার পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) মিলনায়তনে এক সভায় তিনি বলেন, ‘তবে যদি আমরা এটি পুরোপুরি বাতিল করতে ব্যর্থ হই, তাহলে অন্তত করহার বৃদ্ধি করে আদর্শ করহারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করবো।’
‘অন্তর্ভুক্তিমূলক বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য দেশীয় রাজস্ব সংগ্রহ: বাংলাদেশের জন্য নীতি সংস্কার অগ্রাধিকার' শীর্ষক এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট ও ইআরএফ।
বর্তমানে রিয়েল এস্টেট খাতে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অবস্থানের ভিত্তিতে বিভিন্ন করহার প্রযোজ্য। জমি ও অ্যাপার্টমেন্টের প্রকৃত মূল্য বিবেচনায় এই হার আদর্শ করের চেয়ে কম।
এক প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা করহারকে স্বাভাবিক করহারের কাছাকাছি আনতে চাই।’
বারবার সুযোগ দেওয়া হয় কেন
প্রতি বছর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং বিনিয়োগ উৎসাহিত করতেই এই সুযোগ দেওয়া হয়। এ নিয়ে আগের সরকারের অর্থমন্ত্রীদের বক্তব্যে যে অভিন্ন সুর দেখা যায় তা হলো, অনেক টাকা কর না দিয়ে গোপনে রাখা হয়, যা অর্থনীতির চক্রের বাইরে থাকে। এটি বৈধ করলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে।
তবে বাস্তবতা ভিন্ন। অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, কালো টাকা সাদা করলেও তা খুব কমই উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটি আবাসন ও জমির বাজারে চলে যায়, যা মধ্যবিত্তের জন্য আবাসন আরও ব্যয়বহুল করে তোলে। বিশ্লেষকদের মতে, কয়েকটি শক্তিশালী গোষ্ঠীর স্বার্থেই এই সুযোগ রাখা হয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ সৎ করদাতাদের প্রতি অবিচার। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলে যারা নিয়মিত কর পরিশোধ করেন, তারা অসন্তুষ্ট হন। কারণ, সৎ করদাতাদের করদানের হার সাধারণত বেশি থাকে, অথচ কালো টাকাধারীরা কম কর দিয়ে বৈধতা পেয়ে যান।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এবং বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এই ধরনের সুবিধাকে দুর্নীতি সহায়ক এবং সৎ করদাতাদের প্রতি বৈষম্যমূলক বলে উল্লেখ করেছে। তারা বলছেন, যারা নিয়মিত আয়কর দেন, তারা উচ্চ হারে কর পরিশোধ করেন, অথচ যারা কর ফাঁকি দেন, তারা মাত্র ১০-১৫ শতাংশ কর দিয়ে অর্থ বৈধ করতে পারেন।
এ প্রসঙ্গে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘এটি দুর্নীতিকে উৎসাহিত এবং সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করে। এতে করে যারা কর ফাঁকি দেয় তারা পুরস্কৃত হয়। এটি দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া মানে সরকার নিজেই কর ফাঁকিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।’
বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ সাধারণত কয়েকটি বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্য বারবার দেওয়া হয়। এনবিআরের কর্মকর্তাদের মতে বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা ছাড়াও রাজনীতিবিদ ও অসৎ আমলা এবং আবাসন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কালো টাকা অর্থনীতির মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে সাদা করার সুযোগ দেয় সরকার।
১. দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তারা
অনেক রাজনীতিক ও আমলাদের প্রচুর অপ্রদর্শিত সম্পদ থাকে, যা সাধারণত ঘুষ, কমিশন বা অনিয়মের মাধ্যমে অর্জিত হয়। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ তাদের এই অবৈধ সম্পদ বৈধ করার সহজ উপায় তৈরি করে। ফলে রাজনৈতিক স্বার্থে প্রায় প্রতি বছরই বাজেটে এই সুবিধা রাখা হয়।
২. কর ফাঁকি দেওয়া ব্যবসায়ীরা
অনেক বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা প্রকৃত আয়ের চেয়ে কম দেখিয়ে কর ফাঁকি দেন। তারা কালো টাকা সাদা করার সুবিধার অপেক্ষায় থাকেন, যাতে কম হারে কর দিয়ে অবৈধ সম্পদ বৈধ করা যায়। বিশেষ করে রিয়েল এস্টেট, আমদানি-রফতানি ও বাণিজ্য খাতের অনেক ব্যবসায়ী এ সুবিধার অন্যতম সুবিধাভোগী।
৩. ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান
অপ্রদর্শিত অর্থের একটি বড় অংশ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে থাকে, যা অর্থনীতিতে একটি ‘অদৃশ্য’ সম্পদ তৈরি করে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলে এই টাকা ব্যাংকিং খাতে প্রবেশ করে, যা ব্যাংকগুলোর জন্য লাভজনক। বিশেষ করে যখন অর্থ সংকট দেখা দেয়, তখন অর্থনীতিতে তারল্য বাড়ানোর জন্য সরকার এ সুযোগ দেয়।
৪. আবাসন ও নির্মাণ খাত
প্রায় প্রতি বছরই আবাসন খাতের জন্য কালো টাকা সাদা করার বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়। কারণ, ফ্ল্যাট ও জমির মূল্যের একটি বড় অংশই সাধারণত অপ্রদর্শিত থাকে। আবাসন ব্যবসায়ীরা সরকারের ওপর চাপ দেন, যাতে এই সুযোগ অব্যাহত থাকে। ফলে বিনিয়োগ অব্যাহত থাকে।
৫. বিদেশে অর্থপাচারকারীরা অনেকেই বিদেশে অর্থপাচার করেন এবং পরে বৈধ পথে দেশে ফিরিয়ে আনতে চান। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকলে তারা কম হারে কর দিয়ে সেই অর্থ দেশে আনতে পারেন। বিশেষ করে যখন বৈদেশিক মুদ্রার সংকট দেখা দেয় তখন সরকার এই ধরনের সুবিধা দিয়ে অর্থ ফেরানোর চেষ্টা করে।
৬. রাজনৈতিক কারণে বিশেষ শ্রেণির সুবিধা
বিভিন্ন সময়ে বিশেষ রাজনৈতিক শ্রেণির সুবিধার্থে কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়। নির্বাচনের আগে বা বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় এ ধরনের সুযোগ বেশি দেওয়া হয়, যাতে নির্বাচনি খরচ নির্বিঘ্নে করা যায় এবং দলীয় অর্থায়ন সহজ হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে কত টাকা সাদা হয়েছে
সমালোচনা যতই হোক, প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর স্বার্থের কারণেই প্রায় প্রতি বাজেটেই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থেকে যায় এটাই বাস্তবতা। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ সুযোগ নিয়ে সাদা হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা।
বিশেষ করে ২০০৭-০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ৩২ হাজারের বেশি ব্যক্তি ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি সাদা করেছিলেন। তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশে প্রকৃত কালো টাকার পরিমাণ আরও অনেক বেশি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ থেকে ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ কালো টাকা হিসেবে ঘুরছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে কী ব্যবস্থা আছে?
বাংলাদেশের মতো অনেক উন্নয়নশীল দেশই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়। তবে উন্নত দেশগুলোতে কর ফাঁকি দিলে বড় অঙ্কের জরিমানা ও শাস্তির বিধান রয়েছে।