
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদের সংশোধিত গঠনতন্ত্রের খসড়ায় বেশ কিছু পরিবর্তনের বিষয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত খসড়ায় গঠনতন্ত্রে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে জুলাই অভ্যুত্থান ও দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চেতনা। থাকছে না বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম।
একই সঙ্গে ডাকসুর কার্যাবলিতে যুক্ত হচ্ছে ‘শিক্ষার্থীদের অধিকার সংরক্ষণ ও সুরক্ষা’র বিষয়টি। কিছুটা কমছে পদাধিকারবলে ডাকসু সভাপতি হওয়া বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের একক ক্ষমতা।
গত মঙ্গলবার ডাকসু ও হল সংসদের গঠনতন্ত্র সংশোধন ও পরিমার্জন কমিটির সভায় এই প্রস্তাবিত সংশোধনীর চূড়ান্ত খসড়াটি করা হয়েছে। মতামতের জন্য গত বুধবার সব ছাত্র সংগঠনকে এটি পাঠানো হয়। ২৫ মার্চ পরবর্তী সিন্ডিকেট সভায় সংশোধন করা প্রস্তাবিত গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কার কমিটির সদস্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ।
এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, শিক্ষার্থী ও ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের প্রস্তাবগুলো আমলে নিয়ে আমরা যতটুকু সংস্কার করে একটি সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন করতে পারি, ততটুকু সংস্কার করেছি। যদি আর কোনো সংশোধন দরকার হয়, তাহলে নির্বাচিত সংসদ সেটি করে নিতে পারবে। ডাকসু গঠনতন্ত্রের দুটি অংশ। প্রথম অংশের নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের গঠনতন্ত্র। দ্বিতীয় অংশের নাম সংসদের জন্য গঠনতন্ত্র। প্রস্তাবিত খসড়ায় বেশির ভাগ উল্লেখযোগ্য সংশোধনীই আনা হয়েছে প্রথম অংশের জন্য।
মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে জুলাই অভ্যুত্থান : বর্তমান গঠনতন্ত্রের প্রথম অংশের দ্বিতীয় ভাগে ডাকসুর পাঁচটি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য রয়েছে। তবে প্রস্তাবিত গঠনতন্ত্রে এখানে একটি নতুন অনুচ্ছেদ যুক্ত হয়েছে। বর্তমান গঠনতন্ত্রে ডাকসুর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে ২(ক) অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে ধারণ ও লালন করার কথা বলা হয়েছে। সংশোধিত গঠনতন্ত্রে এর সঙ্গে একটু নতুন অনুচ্ছেদ ২(খ) যুক্ত করা হয়েছে, যেখানে ২০২৪ সালের বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদবিরোধী জুলাই অভ্যুত্থান এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যসব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চেতনাকে প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছে।
বাদ পড়ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বঙ্গবন্ধুর কথা : ডাকসু গঠনতন্ত্রের পঞ্চম ভাগে সংসদের পদাধিকারী ও তাদের কার্যাবলির উল্লেখ রয়েছে। সংশোধিত গঠনতন্ত্রের খসড়ায় ‘স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক’ পদের নাম বদলে করা হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক’। নামের সঙ্গে কিছুটা বদলেছে কাজও। ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এখানে যুক্ত হয়েছে দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোর চেতনাকে তুলে ধরার কাজও। বাদ পড়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমতা ও সমান সুযোগ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বঙ্গবন্ধুর দর্শনের মতো বিষয়গুলো।
কিছুটা কমছে উপাচার্যের ক্ষমতা : গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদাধিকারবলে সংসদের সভাপতি। প্রস্তাবিত সংশোধিত গঠনতন্ত্রের অন্তত দুটি অনুচ্ছেদে সভাপতির একক কার্যপরিধি বা ক্ষমতা কিছুটা কমানো হয়েছে।
বর্তমান গঠনতন্ত্রের ৫(ক) অনুচ্ছেদে অনুযায়ী, সভাপতি গঠনতন্ত্রে উল্লিখিত নিয়ম ও প্রবিধান অনুযায়ী সংসদ পরিচালনা নিশ্চিত করবেন এবং জরুরি, অচলাবস্থা বা গঠনতন্ত্র ভঙ্গের মতো পরিস্থিতিতে সংসদের সুষ্ঠু কার্যক্রম নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। সভাপতি সব বিধি বা নিয়ম-কানুনের ব্যাখ্যা দেবেন এবং তার ব্যাখ্যা চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। তবে সংশোধিত খসড়ায় সভাপতির নিয়মের ব্যাখ্যা দেওয়া ও তা চূড়ান্ত বলে গণ্য হওয়ার বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে।
বর্তমান গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সংসদের সর্বোত্তম স্বার্থে সভাপতি যেকোনো সময় নির্বাহী কমিটির যেকোনো পদাধিকারী বা সদস্যকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা রাখেন। পুরো নির্বাহী কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন আহ্বান করা বা সংসদ পরিচালনার জন্য অন্য যেকোনো ব্যবস্থা বা সিদ্ধান্ত উপযুক্ত মনে করলে সভাপতি তা নিতে পারবেন। সংশোধিত খসড়াতেও সভাপতির এসব পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ রয়েছে, তবে তা ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের অনুমোদন সাপেক্ষে’। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে সভাপতির এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমছে।
বর্তমান গঠনতন্ত্রের প্রথম অংশের ষষ্ঠ ভাগে পদাধিকারীদের নির্বাচন নিয়ে কথা বলা হয়েছে। এই অংশের ৬(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মধ্য থেকে কোষাধ্যক্ষ মনোনীত করবেন। প্রস্তাবিত খসড়াতেও বলা হয়েছে, উপাচার্যই কোষাধ্যক্ষ মনোনীত করবেন, তবে তা তিনি করবেন সংসদের নির্বাহী কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে।
অষ্টম ভাগে উল্লিখিত ‘দপ্তর বণ্টন’ অংশের ৮(ত) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্বাচনসংক্রান্ত যেকোনো আপত্তি বা অভিযোগ ফলাফল প্রকাশের তিন কার্যদিবসের মধ্যে সভাপতির কাছে দাখিল করা যাবে এবং এ ক্ষেত্রে সভাপতির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। বর্তমান গঠনতন্ত্রে বলা আছে, ‘সভাপতির এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিচারিক আদালতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না।’ তবে এই লাইনটি সংশোধিত খসড়া থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। একই কথা বাদ দেওয়া হয়েছে গঠনতন্ত্রের দ্বিতীয় অংশের ৬৯ নম্বর অনুচ্ছেদ থেকেও।
শিক্ষার্থীদের অধিকার সংরক্ষণ ও সুরক্ষায় ডাকসু, আরো যেসব পরিবর্তন : বিদ্যমান গঠনতন্ত্রের প্রথম অংশের তৃতীয় ভাগে উল্লিখিত ডাকসুর কার্যাবলি মোট আটটি। সংশোধিত খসড়ায় এর সঙ্গে আরো একটি যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন যুক্ত হওয়া ৩(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকার সংরক্ষণ ও সুরক্ষায় ছাত্র সংসদ সব সময় সচেষ্ট থাকবে।
এ ছাড়া ৩(গ) অনুচ্ছেদে বিতর্ক, নাটক, লেকচার, অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মিলনমেলার আয়োজন করার কথা থাকলেও সংশোধিত খসড়ায় এবার ‘নাটকে’র বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে। ৩(চ) অনুচ্ছেদে প্রতিবছর বিতর্ক প্রতিযোগিতার জন্য অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিনিধি পাঠানো বা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানোর কথা বলা থাকলেও এবার সংশোধিত খসড়ায় ‘প্রতিবছরে’র বাধ্যবধকতার বিষয়টি বাদ পড়েছে। সেই সঙ্গে বিতর্ক প্রতিযোগিতার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ‘সম্মেলন ও অনুরূপ কর্মসূচি’।
গঠনতন্ত্রের পঞ্চম ভাগে সংসদের পদাধিকারী ও তাদের কার্যাবলি অংশের ৫(ছ) অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ‘কমন রুম ও ক্যাফেটেরিয়া বিষয়ক সম্পাদক’ পদের নাম বদলে হচ্ছে ‘কমন রুম, রিডিং রুম ও ক্যাফেটেরিয়া বিষয়ক সম্পাদক’। কাজের পরিধিতে যুক্ত হচ্ছে রিডিং রুমের দায়িত্বও।
এ ছাড়া ৫(ঝ) ও ৫(ঞ) অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘সাহিত্য সম্পাদক’ ও ‘সাংস্কৃতিক সম্পাদক’ নামে আলাদা পদ ও কাজ থাকলেও প্রস্তাবিত খসড়ায় তা ‘সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক’ নামের মাধ্যমে এক করা হয়েছে। প্রস্তাবিত এই গঠনতন্ত্র নিয়ে ঢাবি শাখা ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক মল্লিক ওয়াসী উদ্দিন তামি বলেন, ‘আমরা এটি এখনো অফিশিয়ালি পাইনি। প্রশাসনের প্রস্তাবিত গঠনতন্ত্র নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আমাদের প্রতিক্রিয়া জানাব।’
ঢাবি শাখা ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন খান বলেন, ‘যে পরিমার্জন করা হয়েছে, তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করি। সভাপতির ক্ষমতা কিছুটা কমানো হলেও দাবির তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল।’
ঢাবি ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাইন আহমেদ বলেন, ‘সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত শিক্ষার্থী প্রতিনিধি, সভাপতির স্বৈরাচারী ক্ষমতা কর্তন, নির্বাচনের নিয়মিত অয়োজন নিশ্চিতের বিধান, নির্বাচন কমিটিতে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি রাখা ইত্যাদি বিষয়গুলোর মতো যে মৌলিক সংস্কার আনার বিষয়ে অধিকাংশ ছাত্র সংগঠন মত দিয়েছিল, সেগুলো আমলে নেওয়া হয়নি।’