
আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনিকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ধারণা ছিল, মোস্ট ওয়ানটেড এই ব্যক্তি হয়তো টেকনাফে কোনো রোহিঙ্গা ক্যাম্পের গহিন এলাকা বা নিজের দেশ মিয়ানমারে বসেই নিয়ন্ত্রণ করত অপরাধের ‘নাটাই’। কিন্তু গত মঙ্গলবার খোদ রাজধানীর কাছে নারায়ণগঞ্জে তার আস্তানার সন্ধানে রীতিমতো বিস্মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারাও। রাজধানীর কাছে আরসা প্রধানের লুকিয়ে থাকা বা আস্তানা তৈরি করা নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলেও মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে বান্দরবানে ডিজিএফআই কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যা এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নেতাকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। দেশে আশ্রয় পাওয়া কক্সবাজারের ক্যাম্পে ক্যাম্পে অস্থিরতা, চাঁদাবাজি, মাদকের কারবার আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করারও অভিযোগ আতাউল্লাহর বিরুদ্ধে।
৯ সহযোগীসহ আরসা প্রধানকে গ্রেপ্তারের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে চার মাসের বেশি সময় ধরে বসবাস করছিল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর এই প্রধান।
প্রশ্ন উঠেছে, আরসা নেতা আতাউল্লাহর মতো দেশের অভ্যন্তরে আর কোনো বড় সশস্ত্র সন্ত্রাসী লুকিয়ে রয়েছে কি না? অবশ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে দেশের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়েছে। যার সুযোগ নিয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীরা। তবে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এখন সক্রিয় হওয়াতেই এরা ধরা পড়ছে।
ঢাকার উপকণ্ঠে মিয়ানমারের এক শীর্ষ সন্ত্রাসী লুকিয়ে থাকা দেশের নিরাপত্তার জন্য কোনো হুমকি তৈরি করে কি না—জানতে চাইলে র্যাবের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘আতাউল্লাহকে সিদ্ধিরগঞ্জে আবিষ্কার করে আমরাও সারপ্রাইজড। এই পর্যন্ত তার চলে আসা আমাদের ভাবাচ্ছে। সে লম্বা চুল, দাড়ি কেটে চেহারা লুকিয়েছে। মিথ্যা পরিচয়ে বাসা ভাড়া নিয়েছিল। ট্রলার ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে চিকিৎসার নাম করে বাসা ভাড়া নিয়েছিল।’
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতা ছিল বলেই আতাউল্লাহসহ তার সঙ্গীদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি। আরও কেউ আছে কি না, সে ব্যাপারেও আমরা কাজ করছি।’
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি একেএম আওলাদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতা সব সময়ই আছে। সন্ত্রাসীরা মুভমেন্ট শুরু করলেই তারা ধরা পড়ছে। আরসা নেতাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও কেউ লুকিয়ে থাকলে তাদেরও আমরা খুঁজে বের করব।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমডোর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘সিদ্ধিরগঞ্জে আরসা কমান্ডার লুকিয়ে থাকা নিঃসন্দেহে আশ্চর্যজনক ব্যাপার। তবে দেশের যে পরিস্থিতি এতে খুব বেশি আশ্চর্যও হওয়া যাচ্ছে না। কেননা ৫ আগস্টের পর থেকে শুধু আরসা নয়, জেল থেকে জঙ্গি, দাগি অপরাধী, খুনি পালিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অধিকাংশ দেশে থাকলেও ধরতে পারছে না। আমাদের ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়ায় তাদের পক্ষে লুকিয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে।’
রোগী সেজে বাসা ভাড়া, ইমাম পরিচয়ে চলাফেরা: আরসা প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনি ও তার সহযোগীরা সিদ্ধিরগঞ্জ ভূমি পল্লীতে কীভাবে বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন, কী পরিচয়ে কীভাবে থাকতেন, সে বিষয়ে বাড়ির কেয়ারটেকার ও আশপাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আতাউল্লাহ পরিচয় দিতেন মসজিদের ইমাম ও মাছ ব্যবসায়ী। পাঞ্জাবি, টুপি ও পাগড়ি পরে বাসা থেকে মাঝে মাঝে বের হতেন। একটানা ১০ থেকে ১২ দিনের বেশি সিদ্ধিরগঞ্জে থাকতেন না আতাউল্লাহ।
সিদ্ধিরগঞ্জের ভূমি পল্লীর ৬নং সড়কের ৭৪নং বাড়িটি ভূমি পল্লী টাওয়ার হিসেবে পরিচিত। দশতলা ভবনটির ৮ তলার যে ফ্ল্যাট থেকে আতাউল্লাহ ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেটির মালিক ইতালি প্রবাসী আব্দুল হালিম সরকার। তার অবর্তমানে দেখভাল করেন তার বন্ধু খোরশেদ। মাসে ২০ হাজার টাকা করে ৫ মাসের ভাড়া অগ্রিম দিয়ে আরসা সদস্যরা ফ্ল্যাটে ওঠে। আরসা প্রধান আতাউল্লাহ গত নভেম্বর মাসে হুমায়ূন কবিরের মাধ্যমে ভবনের তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়। সেখানে এক মাস থাকার পর চলে যায় ৮ তলায়।
তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটটির মালিক হুমায়ুন কবিরের ভগ্নিপতির। হুমায়ুন বাসাটির দেখভাল করতেন। তিনি বলেন, ভাড়ার নোটিশ দেখে গত অক্টোবরে এক ব্যক্তি ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে আসে। নাম বলে এমরান। তার আত্মীয় অসুস্থ, তাকে নারায়ণগঞ্জ পপুলার হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হচ্ছে, এ কথা বলে আমার কাছ থেকে ভাড়া নেয়। নভেম্বর মাসে সে ফ্ল্যাটে ওঠে। আতাউল্লাহ হাঁটত লাঠিতে ভর করে। ডাক্তার দেখানোর কথা বলে মাঝে মাঝে বাসা থেকে বের হতো। তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটে এক শিশুসহ তিনজন থাকত। কিছুদিন যাওয়ার পর থেকে মাঝে মাঝে তার বাসায় লোকজন আসত। তারা কয়েকদিন থেকে আবার চলে যেত।
তৃতীয় তলায় এক মাস ১০ দিন থাকার পর ৮ম তলার ফ্ল্যাটে চলে যায় আতাউল্লাহ ও তার সঙ্গীরা। আট তলা ফ্ল্যাটের দেখভালের দায়িত্বে থাকা খোরশেদ ও ভবনের কেয়ারটেকার ইমরান জানান, আতাউল্লাহ নিজেকে মধ্যপ্রাচ্যের কাতারের একটি মসজিদের ইমাম বলে পরিচয় দেয়। সে ও তার সঙ্গে যারা ছিল তারা চট্টগ্রামে কয়েকটি ট্রলার দিয়ে মাছের ব্যবসা করে বলে পরিচয় দিত। মাসে ভাড়া দিত ২০ হাজার টাকা। ভাড়া দেওয়ার সময় তাদের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র চাইলে দেব, দিচ্ছি বলে দিন কাটিয়ে দেয়।
পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা রোজিনা বেগম বলেন, তারা প্রায় তিন মাস আমাদের পাশে থাকলেও কোনোদিন তাদের সঙ্গে কথা হয়নি। সারাক্ষণ দরজা বন্ধ করে রাখত। বাসায় নারী ও দুজন শিশু ছিল। অথচ কোনোদিন দেখা হয়নি। বাসায় নারী ও শিশু আছে তা বোঝাই যেত না।
ভবনের একটি ফ্ল্যাট মালিক মোশারফ হোসেন বলেন, তারা খুব চুপচাপ বাসায় আসা-যাওয়া করত। কারও সঙ্গে কথা বলত না। গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে আতঙ্কবোধ করছি। আমাদের পাশে এত বড় ভয়ংকর লোক বসবাস করেছিল।
একই সময়ে ময়মনসিংহে বাসা ভাড়া নেয় আরসা সদস্যরা: ময়মনসিংহ শহরের নতুনবাজার মোড়ের একটি ভবন থেকে গত রোববার রাতে আরসার চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। রাত ১টা থেকে পৌনে ৩টা পর্যন্ত নতুনবাজার মোড়ের বহুতল ভবন গার্ডেন সিটিতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় তাদের সঙ্গে দুই শিশুও ছিল।
সিটি ভবন নামের ১৫ তলা ভবনটির মালিক মাজহারুল ইসলাম। তিনি নরসিংদীর পলাশে থাকেন। বাসাটি ভাড়া দিয়েছিলেন ভবনের দারোয়ান নিজাম উদ্দিন। নিজাম বলেন, ভাড়ার নোটিশ দেখে চার মাস আগে দুই ব্যক্তি বাসাটি ভাড়া নিতে চায়। তারা নিজেদের বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জের তারুন্দিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা বলে পরিচয় দেয়। একজনের নাম বলে মনিরুজ্জামান।
দারোয়ানের বাড়িও ঈশ্বরগঞ্জ। তাদের বিশ্বাস করে মালিকের সঙ্গে কথা বলিয়ে ২০ হাজার টাকায় ভাড়া দেন তিনি। ভাড়া দেওয়ার সময় তাদের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র চান তিনি। তবে তারা দেব, দিচ্ছি করে অনেকদিন কাটিয়ে দেয়। পরে মনিরুজ্জামান একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি দেয়, যেখানে বাড়ি উচাখিলা ইউনিয়নের চর আলগী লেখা। বাবার নাম লেখা ছিল মো. আতিকুল ইসলাম। কিন্তু বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় বলেছিল তার বাড়ি তারুন্দিয়া। তিনি আর বিষয়টি গুরুত্ব দেননি।
ভবনে থাকা মসজিদে ইমামতি করেন আবু সুফিয়ান। তিনি বলেন, নতুন ভাড়াটিয়া কয়েকদিন নামাজ পড়েছিল, কিন্তু পরে আর নামাজ পড়েনি। তাদের নামাজের কথা জিজ্ঞেস করা হতো, এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নানাজ পড়ানো হয়, তারাবি পড়ানো হয়। তখন তারা বলত আমরা তো হুজুর শ্রেণির লোক, আমরা নিজেরাই নামাজ পড়ি।
ভবনটির ১১তলার বাসিন্দা আনিসুর রাজ্জাক ভূঁইয়া বলেন, এই ফ্ল্যাটে যারা থাকত, তারা ভবনের অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত না। নিজেদের ফ্ল্যাটের দরজাও খুলত না।
কোতোয়ালি মডেল থানার পুলিশ জানিয়েছে, ময়মনসিংহ নগর থেকে গ্রেপ্তার হওয়া চারজনের মধ্যে তিনজন ভাইবোন। আসমত উল্লাহ, শাহিনা আক্তার ও ১৭ বছর বয়সী তরুণী ভাইবোন। তারা মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের কাউনিয়া বিল এলাকার বাসিন্দা হলেও উখিয়ার থ্যাংকালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকত। গ্রেপ্তার অন্যজন মো. হাসান। সে আরাকানের খুনকুন এলাকার বাসিন্দা হলেও কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকত। মামলায় আরসার সদস্যদের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা, ১২ ভরি স্বর্ণ, বিদেশি মুদ্রা, আরসা আর্মি লেখা ১৫টি নেমপ্লেট, মিলিটারি শার্টসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ দেখানো হয়েছে।
ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মো. শফিকুল ইসলাম খান বলেন, রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য অবস্থান করায় ১০ জনকে আসামি করে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। যেহেতু তাদের নারায়ণগঞ্জের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে তোলা হয়েছে, ময়মনসিংহের পুলিশ গ্রেপ্তারের জন্য আদালতের কাছে আবেদন করবে। তাদের ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হবে।