
মাত্র এক মাস আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিনের এক ফোনালাপ ইউরোপের উদ্দেশে স্পষ্ট বার্তা পাঠিয়েছিল—যুক্তরাষ্ট্র হয়তো চিরকাল ইউরোপকে রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে থাকবে না। এরপর এই সপ্তাহে যখন দুজনের আবার কথা হলো, তখন কূটনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক তৎপরতার ফলে ইউরোপ তার জোট পুনর্গঠন করেছে এবং দীর্ঘদিনের নীতি পরিবর্তন করেছে—এক ধরনের দৃঢ়তা দেখিয়ে, যা সাধারণত পুরনো মহাদেশের সঙ্গে ততটা সম্পৃক্ত নয়।
জার্মান মার্শাল ফান্ড থিংকট্যাংকের ইয়ান লেসার বলেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসনের আগমন ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছে এবং কী করতে হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্পষ্টতা এনেছে।’
এই পরিবর্তনের নানা দিক এবং ভবিষ্যতে কী হতে পারে, তা নিয়েই বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ২৭ সদস্য রাষ্ট্রের নেতারা ছয় সপ্তাহের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো সম্মেলনে বসছেন, যেখানে ইউরোপের প্রতিরক্ষা জোরদারের বিষয়ে আলোচনা হবে।
‘নতুন খেলোয়াড়দের’ আবির্ভাব
ব্রাসেলস থেকে প্যারিস, লন্ডন এবং আবার ব্রাসেলস—ইউক্রেন বিষয়ে মস্কোর সঙ্গে ট্রাম্পের সংলাপের পর ইউরোপজুড়ে কূটনৈতিক তৎপরতা বিভিন্ন সীমারেখাকে অস্পষ্ট করে দিয়েছে। ক্রমাগত বৈঠকের ফলে ইইউর ভেতরে ও বাইরে থাকা দেশগুলোর বিভিন্ন উপদল সক্রিয় হয়েছে, আর ইইউর আনুষ্ঠানিক আলোচনায় যুক্তরাজ্য ও কানাডার মতো ‘মনোভাবের মিল থাকা’ অংশীদারদের অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়েছে, যা এবারও অব্যাহত থাকবে। অন্যদিকে ন্যাটোর মহাসচিব প্রায় প্রতিটি আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন, যেন নতুন মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করা যায়।
এই পরিবর্তনগুলোর অন্যতম কারণ হলো হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান, যিনি ট্রাম্প ও রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ এবং ইউক্রেন ইস্যুতে ইইউর ঐকমত্যের পথে বারবার বাধা সৃষ্টি করেছেন।
পরিস্থিতি সামাল দিতে এবারও ব্রাসেলসে ২৬ সদস্য রাষ্ট্রের যৌথ বিবৃতি অনুমোদনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যাতে ওরবানের বিরোধিতাকে পাশ কাটানো যায়। ইইউর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা একে ওরবানের সঙ্গে ‘কৌশলগত মতপার্থক্য’ বলে উল্লেখ করেছেন।
এদিকে ইউক্রেনকে সমর্থন দিতে ‘ইচ্ছুকদের জোট’ গঠনের প্রক্রিয়া এবং দীর্ঘ মেয়াদে ইউরোপের প্রতিরক্ষা জোরদারের চেষ্টার প্রতিফলন হিসেবেও এই কৌশলগত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।
লেসার বলেন, ‘এটি স্পষ্ট যে ইউরোপ এখন প্রতিরক্ষাব্যবস্থার প্রতি শুধু আরো গুরুত্বই দিচ্ছে না, বরং তারা আরো স্বাধীনভাবে পরিচালনার কথাও ভাবছে।
তিনি আরো বলেন, ভবিষ্যতে ন্যাটোর ভেতরেই ‘একটি শক্তিশালী ইউরোপীয় কেন্দ্র’ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
পুরনো মিত্রদের প্রত্যাবর্তন
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কমে যাওয়ার অন্যতম বড় প্রভাব পড়েছে যুক্তরাজ্যের ওপর, যা ব্রেক্সিট-পরবর্তী সময়ে ইউরোপের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক গড়তে তেমন আগ্রহী ছিল না। যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সম্পৃক্ত রাখা, সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি অর্জন ও ইউরোপের নিরাপত্তা জোরদারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
ইউরোপীয় পররাষ্ট্র সম্পর্ক পরিষদের (ইসিএফআর) নীতিনির্ধারক ক্যামিল গ্র্যান্ড বলেন, ‘এটি সত্যিই যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে সাহায্য করেছে।
তবে স্বল্প মেয়াদে ইউরোপের প্রতিরক্ষা তহবিল নিয়ে দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকতে পারে। ইইউর প্রস্তাবিত ১৫০ বিলিয়ন ইউরোর পুনর্গঠন ঋণ কর্মসূচিতে ‘শুধু ইউরোপীয় উৎপাদিত’ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে যুক্তরাজ্য ইইউর সঙ্গে একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করলে এই প্রকল্পের অংশ হতে পারে।
স্টারমার ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ ইউক্রেন ইস্যুতে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করায় ইইউ-যুক্তরাজ্য নিরাপত্তা সহযোগিতার সম্ভাবনাও আরো উজ্জ্বল হচ্ছে।
নিয়ম ভাঙার প্রস্তুতি?
যুক্তরাষ্ট্রের সুরক্ষার ছায়া হারানোর আশঙ্কায় ইইউর ঐতিহ্যগত বাজেট ঘাটতির নিয়ম-কানুনও নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। ইইউ এখন তার আর্থিক নিয়ম চার বছরের জন্য স্থগিত রাখতে চায়, যাতে প্রতিরক্ষা খাতে ৬৫০ বিলিয়ন ইউরো ব্যয়ের সুযোগ তৈরি হয়। আগে যেসব দেশ এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করত, তারাও এখন নীরবে সম্মতি জানাচ্ছে।
জার্মানির মতো ব্যয়ের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগতভাবে সতর্ক দেশও তাদের অবস্থান বদলাচ্ছে। সম্ভাব্য চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মেৎসের নেতৃত্বে দেশটি ‘প্রতিরক্ষা ব্যয়ে বিপ্লবী পরিবর্তন’ আনতে চাইছে।
আরো বিস্ময়কর বিষয় হলো, মেৎস যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সঙ্গে যৌথ পরমাণু প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন, আর পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টুস্ক এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
লেসার বলেন, ‘সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে অনেক নিষিদ্ধ বিষয়বস্তু ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এটি শুধু প্রতিরোধব্যবস্থা বা অর্থায়নসংক্রান্ত বিষয় নয়, বরং সামগ্রিক কৌশলগত চিন্তা-ভাবনার দিকেও ইঙ্গিত করছে।’
তবে একটি বড় বাধা এখনো রয়ে গেছে—জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস এখনো ইইউর পক্ষ থেকে বড় পরিসরে যৌথ ঋণ গ্রহণের বিরোধিতা করছে, যেমনটি কভিড মহামারির সময় করা হয়েছিল। ইইউর শীর্ষ কূটনীতিক কাজা কালাস বুধবার বলেন, ‘এই মুহূর্তে এটি বাস্তবায়নের পর্যায়ে নেই। তবে এটি পুরোপুরি বাতিলও হয়নি।’