
ভালো ও মন্দ ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখতে পারছে না সরকারি ও বেসরকারি খাতের ১৩টি ব্যাংক। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে এসব ব্যাংকে মোট প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে প্রভিশন ঘাটতিতে শীর্ষে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ২৭ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) ছাড়া পাঁচ ব্যাংকই প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখন ব্যাংকের যে অবস্থা তাতে প্রভিশন ঘাটতি হবে। কারণ দিন দিন খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এভাবে প্রভিশন বাড়তে থাকলে ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে যাবে। প্রভিশন ঘাটতি কমাতে হলে আগে খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করে দিতে হবে, যাতে টাকাগুলো আবার ফেরত আসে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে কয়েকটি ব্যাংকের প্রভিশন উদ্বৃত্ত থাকায় ব্যাংক খাতের সার্বিক প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। আগের প্রান্তিকে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর শেষে এই পরিমাণ ছিল ৫৫ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংক খাতের প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৫০ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা বা ৪৭ দশমিক ৮২ শতাংশ।
নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে পরিচালন মুনাফার দশমিক ৫ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত সাধারণ ক্যাটাগরির ঋণের বিপরীতে প্রভিশন হিসেবে রাখতে হয়। নিম্নমানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ এবং সন্দেহজনক খেলাপি ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া প্রতিটি ব্যাংকের জন্য মন্দ বা লোকসান ক্যাটাগরির খেলাপি ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশনিং আলাদা করে রাখার বিধান রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ডিসেম্বর শেষে সবচেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। এই ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ২৭ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের ঘাটতি ১৮ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। তৃতীয় অবস্থানে আছে শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি ১৩ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া স্যোশাল ইসলামী ব্যাংকের ১০ হাজার ৬০৩ কোটি, সেনালী ব্যাংকের ৯ হাজার ৩০ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ৮ হাজার ৮৮৯ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংকের ৭ হাজার ৮৮৬ কোটি, রূপালি ব্যাংকের ৭ হাজার ২২ কোটি, বেসিক ব্যাংকের ৫ হাজার ১৭০ কোটি, কমার্স ব্যাংকের ৫৩৩ কোটি, স্ট্যার্ন্ডাড ব্যাংকের ৩০৭ কোটি, ঢাকা ব্যাংকের ১৭৬ কোটি ও আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ২ লাখ টাকার প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে।
গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি বলেন, ‘প্রভিশন নিরাপত্তা সঞ্চিতি খেলাপি ঋণের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। যদি কোনো ব্যাংক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এটি সংরক্ষণ করতে না পারে, তাহলে তাদের ব্যবসা করতে দেওয়া উচিত হবে না বলে মনে করি। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ বাড়তে দেওয়া কোনো অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়। খেলাপি কমাতে অবশ্যই ব্যাংকগুলোকে কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। সর্বোপরি ব্যাংক খাতের প্রাতিষ্ঠানিক মজবুতি অর্জন একান্ত জরুরি। তা না হলে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে আবারও খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
প্রভিশন ঘাটতি ব্যাংক খাতের জন্য একটি অশনিসংকেত, কারণ এটি ব্যাংকগুলোর দুর্বল আর্থিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরে, যা মূলত উচ্চ খেলাপি ঋণের ফল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বর শেষে যার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৬০ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা বা ১৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের অর্থ এখন খেলাপি ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। গত সাড়ে ১৫ বছরে ঋণখেলাপি ও প্রভাবশালীদের একাধিক ছাড় দেওয়ার ফলে খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এই ছাড় নীতি বাস্তবায়ন করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক দুই গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ও ফজলে কবির। সরকার পরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ নীতি থেকে সরে গিয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা প্রয়োগ করেছে। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতার কারণেও ঋণ পরিশোধ কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ব্যাংকগুলো আগে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাত না। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন খেলাপির সঠিক চিত্র বেরিয়ে আসছে। দুর্বল ১৫টি ব্যাংক নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকও বেশ চিন্তিত। সেই ব্যাংকগুলোর খেলাপি ও প্রভিশন ঘাটতি বেশি। ব্যাংকগুলো গত এক বছরে আহামরি কোনো ব্যবসা করেনি, যা দিয়ে প্রভিশন রক্ষা করবে। এর ফলে প্রভিশনে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় ব্যাংকে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে ব্যাংক সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। সেখানে ব্যাংক রেজল্যুশন অ্যাক্ট তৈরির কাজ চলছে। সংস্কার কমিশনের পরামর্শের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর শেষে সরকারি ব্যাংকগুলোয় প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বর শেষে যার পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ১৭ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা বা ৩০ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৪৮ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বর শেষে যা ছিল ১৫ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা। সে হিসাবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৩৩ হাজার ৫২ কোটি টাকা বা ৬৭ দশমিক ৬১ শতাংশ।
অন্যদিকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে বিদেশি ব্যাংকগুলোর প্রভিশন সংরক্ষণ করার কথা ছিল ২ হাজার ২২৫ কোটি টাকা। তবে এ ব্যাংকগুলো আলোচ্য এ সময়ের মধ্যে প্রভিশন রেখেছে ২ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ডিসেম্বর শেষে বিদেশি ব্যাংকগুলোর ৪৬৩ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত রয়েছে। একই সময়ে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোরও উদ্বৃত্ত রয়েছে ২৫৫ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর প্রভিশন রাখার কথা ছিল ২ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা, যেখানে ব্যাংকগুলো রেখেছিল ৩ হাজার ৮৪ কোটি টাকা।