
আবদুল হামিদ। ভারতে পলাতক স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের সাবেক রাষ্ট্রপতি। দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম সময় বঙ্গভবনের বাসিন্দা হিসাবে রেকর্ড গড়া এই রাষ্ট্রপতি গত বছর বেরিয়ে আসেন চার দেওয়ালের বাইরে। সপরিবারে গিয়ে ওঠেন রাজধানীর অন্যতম অভিজাত এলাকা নিকুঞ্জের এক ডুপ্লেক্স বাড়িতে। তবে এর আগেই নিকুঞ্জের চেহারা পুরোপুরি পালটে দেওয়া হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতিকে খুশি করতে রীতিমতো ঢেলে সাজানো হয় চারপাশ। ফুলবাগান, ওয়াকিং ওয়ে ছাড়াও নির্মাণ করা হয় পরিপাটি রাস্তা। পরিত্যক্ত নিকুঞ্জ খাল হয়ে ওঠে পদ্মফোটা দৃষ্টিনন্দন লেক।
তবে হামিদের কপালে এমন সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আগস্টের রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে হাসিনার পতনের পর হামিদ নিজেও গা ঢাকা দেন। শখের বাড়ি ছেড়ে অজ্ঞাত স্থানে পালিয়ে যান তিনি। সেই থেকে ‘সাধের বালাখানা’ ক্রমেই পরিণত হয় পরিত্যক্ত বাড়িতে। বর্তমানে এটি দাঁড়িয়ে আছে সীমাহীন আওয়ামী দুঃশাসন, স্বেচ্ছাচারিতা আর দুর্নীতির প্রতিচ্ছবি হয়ে।
যেভাবে গচ্চা গেল ২৪ কোটি : লেকড্রাইভ রোডের ৬ নম্বর প্লটে হামিদের তিনতলাবিশিষ্ট ডুপ্লেক্স বাড়ি। কর্নার প্লট হওয়ায় বাড়ির দুইদিক ফাঁকা। সামনের অংশে প্রবহমান খাল। দুপাশে হাঁটার (ওয়াকওয়ে) বাঁধানো রাস্তা। নান্দনিক ডিজাইনে তৈরি ডেক ও ঝুলন্ত ব্রিজ। দেশি-বিদেশি ফুল ও শৌখিন পাতাবাহারে সজ্জিত চারপাশ। এমনকি খালের পানিতেও ভাসছে পদ্মফুল। সারি সারি খেজুরগাছ লেকের পাড়ঘেঁষে। গাছের খাঁজে খাঁজে নিয়মিত রস সংগ্রহের চিহ্ন। খালসংলগ্ন রাস্তা আলোকিত করতেও রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। কিছুদূর পরপর বসানো হয়েছে অত্যাধুনিক ল্যাম্প পোস্ট।
রাজউক সূত্র জানায়, এর সবই তৈরি হয় সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সুখবিলাসের জন্য। তিনি বঙ্গভবন ছেড়ে নিকুঞ্জে ওঠার আগেই এলাকা ঘিরে ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম চালানো হয়। বিশেষ করে তার বাড়ির সামনের খাল সংস্কারে দুহাতে টাকা ঢালে সরকার। এমনকি প্রকল্পের অংশ না হলেও পূর্বাচল নতুন শহর ঘিরে একশ ফুট চওড়া খাল খনন প্রকল্পের আওতায় খালটি সংস্কার করা হয়। রাজউকের তত্ত্ববাধানে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। এতে ২৪ কোটি টাকারও বেশি অর্থ খরচ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং পূর্বাচল লিংক রোডের ১০০ ফুট খাল খনন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) এমএম এহসান জামীল যুগান্তরকে বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সুবিধার জন্য নিকুঞ্জ খাল সংস্কার করা হয়েছে, এমনটি বলা যাবে না। খালটি পরিত্যক্ত থাকায় আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিয়মিত জলাবদ্ধতা দেখা দিত। এ সমস্যা নিরসনে নিকুঞ্জ খালের সঙ্গে স্থানীয় আরও কয়েকটি খাল সংস্কার করা হয়।
জানা যায়, রাষ্ট্রপতি হিসাবে বঙ্গভবনে ১০ বছরেরও বেশি সময় কাটিয়ে ২০২৩ সালের এপ্রিলে আবদুল হামিদ সপরিবারে নিকুঞ্জের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। এরপর এলাকাটি রীতিমতো নিরাপত্তার চাদরে ঘিরে ফেলা হয়। এ সময় স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়া সাধারণের প্রবেশে ব্যাপকভাবে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। তবে পট পরিবর্তনের পর আবদুল হামিদ পালিয়ে গেলে আলোচিত বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে।
সোমবার দুপুরে সেখানে গেলে দেখা যায় বাড়ির প্রধান ফটক ভেতর থেকে বন্ধ। ভেতরে তেমন কারও সাড়াশব্দ নেই। একপর্যায়ে দরজায় টোকা দিলে মাহমুদ নামের একজন পুলিশ সদস্য বেরিয়ে আসেন। তিনি জানান, বাড়িতে সাবেক রাষ্ট্রপতির পরিবারের কেউ নেই। তবে লুটপাটের শঙ্কা থেকে ডিএমপির (ঢাকা মহানগর পুলিশ) পক্ষ থেকে ফোর্স মোতায়েন রয়েছে। এখানে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিয়মিত পালা করে দায়িত্ব পালন করছেন।
স্থানীয়রা জানান, বর্তমানে প্রায় প্রতিদিন দেশের দূরদূরান্ত থেকে উৎসুক জনতা একনজর হামিদের বাড়িটি দেখতে আসছেন। তাদের কেউ ছবি তুলছেন। কেউবা বাড়িসহ আশপাশের এলাকার ভিডিও ইউটিউবে আপলোড করছেন। ৫ ডিসেম্বর আপলোড করা এমন একটি ভিডিওর নিচে দর্শকদের অনেকে নানা ধরনের মন্তব্য লেখেন। গোলাম মোস্তফা নামের একজন লেখেন, ‘আওয়ামী লীগ করলেও উনি ভদ্রলোক ছিলেন।’ সামিনা খাতুন নামের আরেকজন লেখেন, ‘এই আবদুল হামিদ বহু ফাঁসির আসামিকে ক্ষমা করেছেন।’ সাইফুল্লাহ নামের একজন লেখেন, ‘আওয়ামী লীগ পালিয়ে যাওয়া নিয়ে ওনার বক্তব্য যদি জানতে পারতাম।’ অনন্যা ইসলাম নামের একজন লেখেন, ‘আমি বিএনপি নেতা হলে বাড়িটি দখল করতাম।’
রাজউক সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর এমপি কোটায় নিকুঞ্জ-১ (দক্ষিণ) আবাসিক এলাকায় প্লট বরাদ্দের আবেদন করেন আবদুল হামিদ। সে অনুযায়ী ৯৭ সালের ৫ অক্টোবর তাকে তিন কাঠা আয়তনের একটি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরে ২০১১ সালে সেখানে বাড়ি নির্মাণের জন্য তিনি নকশা অনুমোদন নেন। সর্বমোট সাড়ে চার লাখ টাকায় প্লট রেজিস্ট্রি করেন আবদুল হামিদ।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেনবাহিনীর গলফ মাঠ, লেক এবং বিমানবন্দরসংলগ্ন হওয়ায় রাজউকের নিকুঞ্জ-১ আবাসন প্রকল্প রাজধানীর অন্যতম অভিজাত এলাকা হিসাবে পরিচিত। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী থেকে শুরু দেশের অভিজাত শ্রেণির অনেকেই এখানে সুখের আবাস গড়ে তুলেছেন। তুমুল চাহিদার কারণে এ এলাকার প্রতিটি প্লট অনেকটা সোনার হরিণ। বর্তমানে সেখানে কাঠাপ্রতি জমির মূল্য আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা।
আওয়ামী দোসরদের পল্লি : নিকুঞ্জ-১ এলাকায় সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ছাড়াও আওয়ামী দোসর হিসাবে পরিচিত আরও অনেকের বাড়ি রয়েছে। হাসিনা সরকারের একাধিক এমপি-মন্ত্রীসহ দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক নেতা এবং হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট ব্যবসায়ীদের অনেকে একেকটি চোঁখ ধাধানো ডিজাইনের বাড়ি নির্মাণ করেছেন। তাদের মধ্যে হামিদের বাড়ির পাশেই সাত নম্বর প্লটে বাড়ি করেছেন পলাতক সাবেক হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন। চার নম্বর রোডের তিন নম্বর বাড়ির মালিক হাসিনার আত্মীয় মোহাম্মদ হোসেন সেরনিয়াবাদ। এছাড়া শেখ হাসিনার সাবেক প্রেস সেক্রেটারি নাইমুল ইসলাম খান, সাংবাদিক নেতা ও হাসিনার সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা ‘ভাতের হোটেলখ্যাত’ ডিবি হারুনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ার হোসেন, নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বাহাদুর ব্যাপারী, কোটিপতি ব্যবসায়ী এবং বেসরকরি বিমান সংস্থা নভোএয়ারের পরিচালক আরশাদ জামাল দিপু, শেয়ারবাজার লুটের অন্যতম হোতা সাবেক এমপি বাদল, শেখ জামাল স্পোর্টিং ক্লাবের অন্যতম পরিচালক বিতর্কিত ব্যবসায়ী ফিরোজ, উত্তরা এলাকার সাবেক এমপি হাবিব হাসান, জনশক্তি রপ্তানি খাতের মাফিয়া হিসাবে পরিচিত আদম ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আবুল বাশার, শেখ পরিবারের প্রভাবশালী সদস্য এবং দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও বিমা খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী কবির হোসেন ওরফে শেখ কবির এবং সুইডেন আওয়ামী লীগের নেতা বিতর্কিত ব্যবসায়ী কাজী শাহ আলম ওরফে ফুল শাহ আলম নিকুঞ্জ এলাকায় বাড়ি করেছেন।
সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীর অন্য কোনো এলাকার সঙ্গে এর মিল নেই। অত্যাধুনিক পাশ্চাত্য নির্মাণশৈলীতে তৈরি সারি সারি ডুপ্লেক্স বাড়ি। প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনে বহুমূল্যবান মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ, ফেরারিসহ বিখ্যাত ব্র্যান্ডের গাড়ি পার্ক করা। এছাড়া অনেক বাড়ির সামনে বিদেশি কুকুরসহ অস্ত্রধারী নিরাপত্তা প্রহরী রয়েছে।
স্থানীয়দের কয়েকজন জানান, সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসাবে এখানে যারা প্রভাবশালী ছিলেন, তাদের বেশির ভাগই এখন পলাতক। বালাখানা নামে পরিচিত তাদের বাড়িগুলো এখন তালাবদ্ধ। ইতোমধ্যে অনেক বাড়ি ভাড়া দেওয়ার জন্য বাইরে টু-লেট নোটিশ টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকটি বাড়িতে নিরাপত্তা প্রহরী থাকলেও সতর্কতার অংশ হিসাবে রাতে আলো নিভিয়ে রাখা হয়। এমনকি নম্বর প্লেট খুলে কালো পর্দায় ঢেকে রাখা হচ্ছে তাদের ব্যবহৃত দামি গাড়িগুলো।