
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল বা জোটের জয়-পরাজয়ে তরুণ ভোটাররাই হবে ট্রাম্পকার্ড। দেশে তরুণ ভোটার তিন কোটি চার লাখ সাত হাজার। তাদের বয়স ১৮ থেকে ২৯ বছর। মোট ১২ কোটি ৪৪ লাখ ৮০ হাজার ভোটারের মধ্যে ২৪ দশমিক ৪২ শতাংশই তরুণ। এদের বড় অংশই শিক্ষার্থী। এদের অধিকাংশই ফ্যাসিস্টদের বাধায় আগে ভোট দিতে পারেনি। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এদের বড় অংশ প্রথমবারের মতো চাপমুক্তভাবে ভোট দেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। এরা শুধু ভোটের ফল নয়, দলগুলোর প্রার্থী মনোনয়নের ধারা পালটে দিতেও ভূমিকা রাখতে পারে। নির্বাচনে জয় পেতে তরুণদের ভোট টানতে নানা ছক কষছে বিএনপি, জামায়াতসহ অন্য দলগুলো। একই সঙ্গে পালন করছে নানা কর্মসূচি, নির্ধারণ করছে কৌশল। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জানান, অতীতে যেসব নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়েছিল, সেগুলোতে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। এবার নির্বাচনে যে রাজনৈতিক দল বা জোট তরুণদের ভোট বেশি টানতে পারবে, নির্বাচনে তারাই ভালো ফল পাবে। তারা আরও জানান, ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে এবার নতুন এক পরিবেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত একতরফা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেসব নাগরিক ভোট দিতে পারেননি, এ নিয়ে তাদের ক্ষোভ আছে। তাদের সবাই এবার ভোটকেন্দ্রে যাবেন। তারা পছন্দের প্রার্থী দেখে ভোট দেবেন। এতে নির্বাচনে একদিকে ভোট পড়ার হার বাড়বে, অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নির্বাচন কমিশন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। তেমনি রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে জয় পেতে অগ্নিপরীক্ষায় পড়তে হবে। দলগুলোকে প্রার্থী বাছাই থেকে শুরু করে মনোনয়ন দেওয়া পর্যন্ত তরুণদের পছন্দ আগ্রহ-অনাগ্রহের বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। এতে নতুন এবং তুলনামূলক কম বয়সি প্রার্থীর সংখ্যা বাড়তে পারে।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দল তরুণদের ৫ শতাংশ ভোট পেলে সে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের চেয়ে ১০ শতাংশ এগিয়ে যাবে, এটাই ভোটের সরল হিসাব। আর তিন কোটি তরুণ তো বিরাট সংখ্যা। যদিও তাদের মধ্যে রাজনৈতিক কিছুটা বিভাজন রয়েছে, তবুও তরুণ ভোটাররা আগামী নির্বাচনে ফলাফল নির্ধারণে বিরাট ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, তরুণরা শুধু নির্বাচন নয়, রাজনীতিতেই ফ্যাক্টর হিসাবে আভির্ভূত হয়েছেন। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে প্রকাশ্য নেতৃত্বে ছিলেন তরুণরা। বুলেটের সামনে আবু সাঈদসহ যারা বুক পেতে দিয়েছেন তাদের প্রায় সবাই বয়সে তরুণ। তারা একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটিয়েছেন। তারা সম্মুখযোদ্ধা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনে তরুণ নেতৃত্বের গুরুত্ব বেড়েছে। ৫ আগস্টের পর সরকার ও দেশের রাজনীতি সংস্কারের দাবি উঠেছে। সেই দাবির সঙ্গে শুধু তরুণরা নয়, অনেক মধ্যবয়স্ক ও বয়স্কদেরও সমর্থন রয়েছে। প্রথাগত রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি জনআকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়েছে।
আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার লক্ষ্যে প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত সোমবার পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ডিসেম্বরে সংসদ নির্বাচন হবে। দেশে নির্বাচনি আবহ বিরাজ করছে। নির্বাচনে অংশ নিতে গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি’ নামে নতুন রাজনৈতিক দলও গঠন করেছে। আরও কিছু নতুন দল গঠন হতে যাচ্ছে। পাশাপাশি নির্বাচনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ করছে অন্তর্বর্তী সরকার।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। অতীতে দেশে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হছে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে। এসব নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেছে কমবেশি ১০ শতাংশ ভোটে জয়-পরাজয় নিশ্চিত হয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল অংশ নেয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত অংশ নিলেও রাতের ভোট হিসাবে খ্যাতি পাওয়া ওই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কাজেই এসব নির্বাচনে জয় বা পরাজয়ের ভোটের হিসাব কোনো কাজে আসবে না।
ইসির পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিন কোটি ৩৬ লাখ ৩৪ হাজার ৬২৯টি ভোট পেয়ে ২৩০টি আসনে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। দলটির প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৪৮.০৪ শতাংশ। ওই নির্বাচনে বিএনপি দুই কোটি ২৭ লাখ ৫৭ হাজার ১০১ ভোট পেয়ে ৩০ আসনে জয় পায়। বিএনপির প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৩২.৫০ শতাংশ। আর জামায়াতে ইসলামী পেয়েছিল ৩২ লাখ ৮৯ হাজার ৯৬৭ ভোট, যা প্রদত্ত ভোটের ৪.৭০ শতাংশ। আসন পায় দুটি। এর আগে ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ৪০.৯৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৯৩ আসনে জয়ী হয়। আর আওয়ামী লীগ ৪০.১৩ শতাংশ ভোটে ৬২ আসন পায়। আর জামায়াতে ইসলামী ৪.২৮ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৮ আসনে জয়লাভ করে।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, দেশে বিদ্যমান ভোটার তালিকার ২৪.৪২ শতাংশ তরুণ। গত ১৭ মার্চ পর্যন্ত হালনাগাদ তালিকায় দেশে মোট ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৪৪ লাখ ৮০ হাজার ৬৮৭ জন। এর মধ্যে ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সি তরুণ ভোটার তিন কোটি চার লাখ সাত হাজার। এছাড়া ৩০-৪১ বছর বয়সি ভোটার সংখ্যা তিন কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার। ৪২-৪৯ বছর বয়সি ভোটার দুই কোটি ১০ লাখ ৯ হাজার এবং ৫০ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সি ভোটার তিন কোটি ৭০ লাখ ৮৯ হাজার। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমের আওতায় নতুন ভোটার যুক্ত হচ্ছেন একই সঙ্গে মৃতদের নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে। এই কার্যক্রমে তরুণ ভোটার বাড়ছে।
তরুণ ভোটার টানার চেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর : জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দল এনসিপি গঠনের বিষয়টি বিভিন্ন মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। গণ-অভ্যুত্থান থেকে নতুন দল গঠনের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। রাজনীতিতে নবীন দলটি তারুণ্যকে কাজে লাগিয়ে আগামী নির্বাচনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ক্লিন ইমেজের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়েও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। যদিও দলটি এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন পায়নি। নির্বাচনে অংশ নিতে হলে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক।
জানতে চাইলে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব মুশফিক উস সালেহীন যুগান্তরকে বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আমরা তরুণরা এক হয়ে আন্দোলন করেছি। আমাদের চাওয়া এক ও অভিন্ন। আগামী নির্বাচনে তরুণদের যে চাওয়া তারই প্রতিফলন যাতে ঘটে, সেজন্য এনসিপি কাজ করছে। তিনি বলেন, ভোটারদের বড় অংশ দীর্ঘদিন নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ রয়েছে। বড় দলগুলোর প্রতি তাদের অনীহা আছে। আমরা তরুণদের সেই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কাজ করছি। পাশাপাশি নির্বাচনি আসনগুলোতে যাদের ক্লিনইমেজ রয়েছে, মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা আছে তাদের নিয়ে এগোনোর পরিকল্পনা রয়েছে।
তরুণদের ভোট টানতে পিছিয়ে নেই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। তরুণদের ভোট টানতে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। দলটির তিন অঙ্গ ও সংযোগী সংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। ঘোষিত ৩১ দফা নিয়ে সারা দেশে যৌথ কর্মী সভা করেছে এই তিন সংগঠন। সংগঠনের নেতারা ইতোমধ্যে বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের হাটবাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন।
জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের অন্যতম নিয়ামক তরুণ ভোটাররা। বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সময়ে তারা ভোট দিতে না পেরে বিক্ষুব্ধ ছিলেন। তাদের ভোটাধিকার রক্ষায় বিএনপি নির্বাচন করেছিল। বিএনপির ৩১ দফায় তরুণদের অনেক কর্মসূচি রয়েছে। তাদের কাছে আমাদের বার্তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।