
ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে সাত মাস আগে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালালেও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এখনো ফ্যাসিস্টের অলিগার্ক মুক্ত হয়নি। হাসিনার তাবেদার পুলিশ-আমলা ও বিভিন্ন সেক্টরের বিতর্কিত কর্মকর্তারা পালালেও এখনো বহাল রয়েছে গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ড. সাবের আহমেদ। হাসিনার এই তাঁবেদার প্রকৌশলী ভুয়া ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে নামের আগে ড. জুড়ে দিয়েছেন।
গত ২০ বছর আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট) দিয়ে সব ধরনের নকশা প্রণয়ন করা হলেও গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। অর্থ বরাদ্দে সরকারের কার্পণ্য না থাকলেও প্রকল্পের পরিচালক রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ড. সাবের আহমেদের অনিয়ম ও দুর্নীতি সরকারি টাকা লোপাট এবং বারবার প্রকল্পের ডিডিপি সংশোধনের নামে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে গড়িমসি করছেন। এ কারণে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা কাটছে না। এসব প্রকল্পে দফায় দফায় সময় ও ব্যয় বাড়ছে। এতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়ের পাশাপাশি জনগণের ভোগান্তি বাড়ছে। ফ্যাসিবাদি সরকার অপচয়, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং জনদুর্ভোগ লাঘবে সোচ্চার হলেও রাজউক যেন এসবের বাইরে। প্রকল্পের শুরু হয়ে কবে শেষ হবে, তার জবাব জানা নেই কারো। রাজউকের স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম-দুর্নীতি এবং লুটপাটের লক্ষ্যে প্রকল্পগুলোর সময় ও ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে। প্রকল্প শুরুর পর নানা কলাকৌশলে প্রকল্প সংস্কার, সময় বৃদ্ধি ও ব্যয় বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এতে লাভবান হচ্ছেন প্রকল্প পরিচালক রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ড. সাবের আহমেদসহ রাজউকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট অন্যরা।
এদিকে রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ড. সাবের আহমেদের গত ১৭ বছরে ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে শত শত কোটি টাকা মালিক হয়েছেন। নিয়েছেন পূর্বাচলে ১০ কাটা জমির প্লট ও রাজধানীর উত্তরা ও মিরপুর রয়েছে দুটি বাড়ি এবং একটি ফ্ল্যাট। তরে তার ডক্টরেট ডিগ্রি সাটিফিকেট ভুয়া বলে জানিয়েছেন রাজউকের কর্মকর্তারা। এদিকে গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক প্রকল্পে ক্ষতিপূরণের টাকা দিতে হাইকোর্টের নির্দেশনা। আবার প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণের টাকা চেয়ে গত ১১ মার্চ ঢাকা জেলা প্রশাসক তানভীর আহমেদ স্বাক্ষরিত চিঠি রাজউকের চেয়ারম্যানকে দেয়া হয়েছে। এর আগে গত কয়েক বছর থেকে ঢাকা ডিসি অফিস থেকে রাউজক চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয়া হচ্ছে। তবে এবারে চিঠি পাওয়ার পরে রাজউক চেয়ারম্যান প্রকল্পে পরিচালক প্রকৌশলী ড. সাবের আহমেদকে ফাইল উপস্থাপনের নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক জমির ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা না দিয়ে নতুন করে উন্নয়ন প্রকল্পের সংশোধন করে ফাইল পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছেন। এভাবে প্রকল্পে ডিপিপি সংশোধন হয় এবং প্রকল্পের ব্যয় বাড়ে আর প্রকল্পে পরিচালকের সরকারি টাকা লুটপাট করা হচ্ছে। গুলশান-বনানী-বারিধারা লেকের উন্নয়ন প্রকল্পের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকলেও প্রতি বছর একই প্রকল্পে অংশ বিশেষ উন্নয়ন দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট পাট করা হচ্ছে। এ প্রকল্প থেকে প্রকৌশলী ড. সাবের আহমেদকে বাদ দেয়ার দাবি জানিয়েছেন মামলার বাদিরা।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, রাজধানীর গুলশান-বনানী-বারিধারা লেকের উন্নয়ন প্রকল্প দৃশ্যমান করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে ডিসি পাঠানো চিঠি পাওয়া গেছে। ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রকল্প পরিচালকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন) মো. নুরুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, বিষয়টি আমি অবগত আছি। তবে প্রকল্প পারিচালককে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, গত ২০২২ সালে রাজধানীর গুলশান, বনানী ও বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তদের বিদ্যমান আইন (২০১৭ সালে প্রণীত আইন) অনুযায়ী, ক্ষতিপূরণ প্রদানের কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, ঢাকা জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ শাখা), ঢাকা ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান পরে এ রুলের জবাব দিলে আদালত ভুক্তভোগী মো. লেহাজউদ্দিনসহ ৮৩ জনের পক্ষে করা রিটের শুনানি নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা দিতে নির্দেশনা দেন। জমি অধিগ্রহণ বাবদ ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। পরিষেবা স্থানান্তরে ৩১ কোটি টাকা, ব্রিজ, ওভারপাস, লেকড্রাইভ, ওয়াকওয়ের জন্য দুই হাজার ১৪৯ কোটি টাকা, লেক খননে ১৪১ কোটি টাকা, কড়াইল বস্তিবাসীর পুনর্বাসনে ১৭ কোটি টাকাসহ বিভিন্ন খাতে মোট খরচ ধরা হয় চার হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজউক ব্যয় করবে ১৪৭ কোটি টাকা। বাকিটা হবে সরকারের অর্থায়নে। যানজট নিরসনের কথা বলে গুলশান-বনানী-বারিধারা লেকের উন্নয়ন প্রকল্প ব্যয় ৪১৪ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে প্রায় পাঁচ হাজার (চার হাজার ৮৮৬ কোটি) টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব করেছিল রাজউক। কিন্তু গণমাধ্যমের কঠোর সমালোচনার মুখে প্রস্তাবিত প্রকল্পের সংশোধিত প্রকল্পের আকার করা হচ্ছে দুই হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। গত ২০১০ সালে গৃহীত ৪১৪ কোটি টাকার প্রকল্পে লেক খনন ও ওয়াকওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবনার সঙ্গে গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট যুক্ত করে যানজট নিরসনের প্রস্তাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে লেকগুলো কার্যকর প্রবহমান করতে ৮০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে গুলশান-বনানী ও বারিধারা লেকের ২২২ একর আয়তন বেড়ে দাঁড়াবে ৩০০ একর। এখন পর্যন্ত রাজউক ২৬০ কোটি টাকা লেক খনন ও উন্নয়নকাজে খরচ করেছে। অথচ গুলশান-বনানী-বারিধারা লেকের কোনো উন্নয়নই দৃশ্যমান নয়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, সড়ক-ফুটপাথ উন্নয়ন ও লেক খননের নামে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ও প্রকৌশলীরা যোগসাজশ করে সব নয়ছয় করছেন। খনন কাজ না করেও বিল উঠিয়ে নিচ্ছেন। এসব কাজের কোনো হিসাব রাখছেন না সংশ্লিষ্টরা।
গত ২০২২ সালে রাজধানীর গুলশান, বনানী ও বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তদের বিদ্যমান আইন (২০১৭ সালে প্রণীত আইন) অনুযায়ী, ক্ষতিপূরণ প্রদানের কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, ঢাকার জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ শাখা), ঢাকা ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যানকে আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। ভুক্তভোগী মো. লেহাজউদ্দিনসহ ৮৩ জনের পক্ষে করা রিটের বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান এবং বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেন। আদালতে রিটকারীদের পক্ষে ব্যারিস্টার শেখ মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম শুনানি করেন। পরে ব্যারিস্টার শেখ মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘২০১৫ সালে রাজধানীর গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করে রাজউক। অধিগ্রহণের আওতায় যাদের জমি পড়েছে, তাদেরকে এলএ কেসের পরিপ্রেক্ষিতে ৩ ধারা এবং ৬ ধারায় নোটিশ করা হয়েছে। অথচ তাদেরকে এখনো পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ করা হয়নি। ক্ষতিপূরণের কোনো টাকা জেলা প্রশাসনে জমা দেয়নি রাজউক। অপরদিকে জমির মালিকরা দু’টি নোটিশপ্রাপ্ত হওয়ায় জমির খাজনা পরিশোধ করতে পারছেন না। এ কারণে জেলা প্রশাসনের দেয়া ৩ ধারা এবং ৬ ধারার নোটিশকে চ্যালেঞ্জ করেছি। শুনানি নিয়ে আদালত বিবাদিদের প্রতি রুল জারি করেছেন।’
ঢাকা মহানগরীর শোভাবর্ধন, অবৈধ দখলদার থেকে লেক উদ্ধারসহ বেশ কিছু উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ২০১০ সালে রাজউক গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সেটি সম্ভব হয়নি। ২০১৫ সালে প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করে ঢাকা জেলা প্রশাসক (ডিসি)। ক্ষতিগ্রস্তদেরকে ৩ এবং ৬ ধারায় নোটিশও করে। অথচ ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের কোনো অর্থ এখনো পর্যন্ত পরিশোধ করা হয়নি। এদিকে খরচ বৃদ্ধি ছাড়াই উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় চারবার। এতেও প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়নি।
বুয়েটের পরামর্শক দলের প্রধান ও পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, গুলশান-বনানী-বারিধারাএলাকায় এমনিতেই যানবাহনের চাপ বেশি। সেখানকার সড়কগুলোতে প্রতিদিন কী সংখ্যক যানবাহন চলে, সেটি গবেষণা করে নকশাটি প্রণয়ন করা হয়েছিল। এটা বাস্তবায়িত হলে পুরো এলাকা উন্নত ও আধুনিক শহরের আদলে গড়ে উঠত। কিন্তু রাজউক কেন গড়িমসি করছে, তা জানি না।
এদিক মামলার বাদি মো. লেহাজউদ্দিনের মৃত্যুর পর বর্তমান বাদি তার পুত্র মো. ফারুক হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের জমি নিয়েছে ২০১০ সালে। তার পরে ডিসি অফিস থেকে ৩ ধারা এবং ৬ ধারা নোটিশ দিয়েছে। আমাদের ক্ষতিপূরণে টাকা দিচ্ছে না। অথচ সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত রাজউক ২৬০ কোটি টাকা লেক খনন ও উন্নয়ন কাজে ব্যয় দেখানো হয়েছে। সে টাকাগুলো প্রকল্পে পরিচালক প্রকৌশলী ড. সাবেরের পেটে গেছে। আবার এ প্রকল্প নিয়ে টালবাহানা করছেন। আমাদের দাবি হচ্ছে প্রকল্পের পরিচালক রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ড. সাবের আহমেদ সরিয়ে দিতে হবে, তা না হলে আগামীতে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে না।এ বিষয়ে প্রকল্পের পরিচালক রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ড. সাবের আহমেদের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেনি।