
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) ভিন্ন এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কয়েকটি কোরামে ভাগ হয়ে গেছেন। প্রতিনিয়ত আসছে মনোমালিন্যের বার্তা। অভিযোগ রয়েছে ইউজিসি’তে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলাম। তাকে অপসারণের দাবি জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতা। পদোন্নতি নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে। আওয়ামী লীগের চিহ্নিত অনেকেই এখন নিজেদের বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্টতার ঘোষণা দিচ্ছেন। এরইমধ্যে সাংবাদিকদের ইউজিসিতে প্রবেশের কড়াকড়ি জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
ড. মো. ফখরুল ইসলাম ছিলেন আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী। শেখ হাসিনাকে নিয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে লিখেছেন একাধিক প্রবন্ধ। গণ-অভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে রাজাকার উল্লেখ করে দিয়েছিলেন স্ট্যাটাস। গণ-অভ্যুত্থানের আগে ইউজিসি’র এই কর্মকর্তা পরবর্তীতে হয়ে যান সচিব। এরপর থেকেই শুরু করেন আওয়ামী লীগ পুনর্বাসন। তার বিরুদ্ধে একাধিকবার আন্দোলন হয়।
আওয়ামী সরকারের আমলে নিয়ম না মেনেই বাগিয়ে নিয়েছিলেন দুটি পদোন্নতি। জুলাই অভ্যুত্থানে তিনি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন- ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা। বঙ্গবন্ধুর বাংলায় রাজাকারের ঠাঁই নাই।’ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পূর্বের সচিব ফেরদৌস জামানকে সরিয়ে দেয়া হয়। তখন নিজ চেয়ারে ছিলেন আওয়ামী লীগের নিয়োগকৃত প্রফেসর অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমগীররা। তারা সেই সময়ে তাদের আস্থাভাজন ফখরুলকে সচিব হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর এক মাস পর নিয়োগ পান ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ। কিন্তু আওয়ামী লীগের আমলে সুবিধাবঞ্চিত দলের সঙ্গে নিজেকেও বঞ্চিতদের কাতারে দাঁড় করান তিনি।
আওয়ামী লীগ আমলে বৈষম্যের শিকার এমন অভিযোগ তুলে বঞ্চিতদের পাশাপাশি পদোন্নতি বাগিয়ে নিয়েছেন কিছু সুযোগ সন্ধানী কর্মকর্তা। দাবির প্রেক্ষিতে পদোন্নতি দেয়ার কারণে বঞ্চিত হয়েছেন অন্তত ৭০/৮০ জন। তাদের দাবি পদোন্নতিতে মানা হয়নি জ্যেষ্ঠতা বা চাকরির শর্ত। বঞ্চিতরা নতুন করে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এমন অভিযোগ তোলার পরও পড়েছেন রোষানলে। এমনকি কমিশনের সভার দিন বহিরাগতদের দিয়ে শোডাউনও করা হয়।
পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তারা বলেন, আমরা আওয়ামী লীগের আমলেও ছিলাম বঞ্চিত। এখনো বঞ্চিত হলাম। সচিব ফখরুল ইসলাম নিজ বলয়ের লোকদের নিয়ে এই পদোন্নতির জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। যাতে বলয় শক্ত হয়। তিনি বলেন, ফখরুল নিজেকে আওয়ামী লীগের সময়ে ঘোর আওয়ামী লীগের পরিচয় দিতেন। এখন তিনি ভোল পাল্টিয়ে হয়েছেন আওয়ামী বিরোধী।
তারা লিখিতভাবে গত ২৬শে জানুয়ারি আলাদা দুটি অভিযোগ করেছিলেন। প্রথম চিঠিতে স্বাক্ষর করেন ৩০ জন কর্মকর্তা।
ফখরুল ইসলাম ২০০৫ সালে সহকারী পরিচালক হিসেবে ইউজিসিতে যোগদান করেন। এরপর ২০১১ সাল হন উপ-সচিব। ২০১৪ সালে পদোন্নতি পেয়ে হন অতিরিক্ত পরিচালক। ২০১৮ সালে হন পরিচালক। জুলাই অভ্যুত্থানের পর ১১ই আগস্ট হন সচিব। কমিশনে এক পদ থেকে অন্য পদে পদোন্নতির যোগ্য হতে কমপক্ষে আগের পদে চার বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। তবে অনেক কর্মকর্তাই সাত-আট বছর হওয়ার পরও পদোন্নতি পান না। কিন্তু ফখরুল ইসলামকে পূর্বের চেয়ারম্যান সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেন। তিনি চার বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই পদোন্নতি পান। পদোন্নতির ক্ষেত্রে ইউজিসিতে যোগদান করার আগের চাকরির অভিজ্ঞতাও যোগ করা হয়েছে। কিন্তু কমিশনের বিধি অনুযায়ী, ইউজিসিতে যোগদানের আগের চাকরির অভিজ্ঞতার অর্ধেক শুধুমাত্র অবসরোত্তর সুবিধার ক্ষেত্রে যোগ হবে।
ফখরুল একাধিকবার ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে ও গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ও সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছেন। যা চাকরির জন্য বাধ্যতামূলক নয়। অভিযোগ রয়েছে, বিএনপি-জামায়াত ঘরনার অনেক কর্মকর্তাকেই তিনি কম গুরুত্বের বিভাগগুলোতে পদায়ন করছেন। তাকে অপসারণের দাবিতে স্মারকলিপি দিয়েছেন ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতার পক্ষে মাহমুদুল হাসান রানাসহ পাঁচ ব্যক্তি। গত ১১ই মার্চ প্রধান উপদেষ্টা বরাবর এ স্মারকলিপি দেয়া হয়।
তার বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ এনে তার বাড়ির সামনে ব্যানারও টাঙানো হয়েছিল। যাতে বিভিন্ন অভিযোগ উল্লেখ করে লেখা হয়, ফ্যাসিস্ট ফখরুল ইসলামকে চাকরিচ্যুত করে অবিলম্বে আইনের আওতায় আনা হোক। জানা যায়, তার নানান বিষয়ে অপকর্ম সামনে আসায় ইউজিসিতে সাংবাদিক প্রবেশে কড়াকাড়ি জারি করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউজিসি’র এক কর্মকর্তা বলেন, কর্মকর্তাদের অনিয়ম, গণ-অভ্যুত্থানে কমিশনের কিছু কর্মকর্তার ভূমিকাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমে কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ হন কমিশনের ঊর্ধ্বতনরা। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হওয়া এটি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, ইউজিসি’র প্রশাসনিক সভায় সাংবাদিকসহ সব ধরনের দর্শনার্থীদের প্রবেশের ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
সাংবাদিকদের প্রবেশের কড়াকড়িতে ক্ষোভ জানিয়েছেন বাংলাদেশ এডুকেশন রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন, বাংলাদেশের (ইরাব) সভাপতি ফারুক হোসাইন। তিনি বলেন, কমিশনের এ ধরনের চিন্তাভাবনা আমাদের অবাক করেছে। এটা দুঃসাহস। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারও ইউজিসিতে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করেনি।
ইউজিসি চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, সাংবাদিক প্রবেশের কড়াকড়ির বিষয়টি সত্য হয়। এ ছাড়াও ইউজিসি’র চলমান পরিস্থিতির বিষয়ে খোঁজ রাখছেন ও ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে ইউজিসি সচিব ড. ফখরুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিস্টের পতনের পর কমিশনে কর্মরত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট-বিরোধী কর্মকর্তা-কর্মচারীগণের রোষানলে কমিশনের তৎকালীন সচিব ড. ফেরদৌস জামানকে সরিয়ে বৈষম্যবিরোধী ও ছাত্র-জনতার পক্ষে থাকা কমিশনের আপামর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবেদন এবং আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে (প্রফেসর ড. কাজী শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বাধীন কমিশন) প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীরসহ কমিশনে কর্মরত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুগত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শুধুমাত্র কমিশনে কর্মরত ফ্যাসিস্ট-বিরোধী কর্মকর্তা-কর্মচারীগণের আবেদন ও তীব্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনের সার্ভিস রুলস ও প্রচলিত বিধি অনুযায়ী আমাকে সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়।
ফুল দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, বিগত সময়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রোগ্রামে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে অংশগ্রহণ এবং ফুল দেয়া এটা তৎকালীন কমিশনের কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী দাপ্তরিক কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের অংশ ছিল।
পদোন্নতির বিষয়ে তিনি বলেন, অনিয়ম করে পদোন্নতির বিষয়টি সর্বৈব অসত্য ও বানোয়াট।
এ ছাড়াও তিনি তার ছেলে ও মেয়ের অভ্যুত্থানের সময়ের ছবি দেখিয়ে বলেন, আমার ছেলে-মেয়েও আন্দোলনের অংশীদার ছিল।
এদিকে, গতকাল সচিবের পদত্যাগ দাবিতে ইউজিসিতে আন্দোলন করেন ফ্যাসিবাদ-বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তারা সচিবের পদত্যাগের দাবি জানান। দিনকে দিন ইউজিসিতে অসন্তোষ বাড়ছে। সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়মিত অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটছে। গতকাল সংবাদ প্রকাশের জেরে মব সৃষ্টি করে সাংবাদিকের ওপর হামলাচেষ্টা করা হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রাপ্যতার অতিরিক্ত অর্থ ঋণ দেয়ার সংবাদ প্রকাশের জেরে মব সৃষ্টি করা হয়। ইউজিসির প্রথম তলায় লিফটের সামনে কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক এ ঘটনা ঘটে।
ভুক্তভোগী সাংবাদিকের নাম মো. শিহাব উদ্দিন। শিহাব দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস ডটকম নামক একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত। অভিযুক্তরা হলেন- ইউজিসি চেয়ারম্যানের রুমে দায়িত্ব পালন করা সিনিয়র সহকারী সচিব মোহা. মামুনুর রশিদ খান ও পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের অফিস সহায়ক খোকন খান। এ ছাড়াও ঘটনার সময় ১০ থেকে ১৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের সঙ্গে ছিলেন বলেন জানান ভুক্তভোগী সাংবাদিক।
পরে ইউজিসি সচিব ফখরুল এবং জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক শামসুল আরেফিনের সহযোগিতায় আমাকে ইউজিসির গাড়িতে আগারগাঁওয়ের মেট্রো স্টেশনের নিচে নামিয়ে দেয়।
সিনিয়র সহকারী সচিব মোহা. মামুনুর রশিদ খান বলেন, আমি চেয়ারম্যান দপ্তরে কর্মরত আছি। এজন্য ঘটনাস্থলে গিয়ে ভুক্তভোগী সাংবাদিককে চেয়ারম্যানের রুমে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। তবে তিনি হামলাচেষ্টায় জড়িত ছিলেন না বলে দাবি করেন।
এ বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, ইউজিসিতে সাংবাদিককে হেনস্তার যে ঘটনা ঘটেছে- সেটি অপ্রত্যাশিত। আমরা ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করছি। ফুটেজ দেখে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।