Image description
 

খান তালাত মাহমুদ রাফি। পুলিশের বুলেটের সামনে দুই হাত ছড়িয়ে হয়েছিলেন সাহসিকতার প্রতীক। তার নেতৃত্বেই চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন পায় নতুন গতি। জন্ম ও বেড়ে ওঠা নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলায়। পড়াশোনা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে।

আন্দোলনে জড়ানো

ছোটবেলা থেকেই আমি সামাজিক কাজে যুক্ত। ২০২২ সালে রেলওয়ের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করি। করোনার সময় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করি। ক্লাস সেভেন থেকে স্কাউটিং করতাম। অ্যাক্টিভিজম শেখার জন্যই মূলত নাট্যকলা বিভাগে ভর্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরির সামনে যেদিন থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, সেদিনই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী চত্বর থেকে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে একাত্মতা পোষণ করি। ৮ জুলাই বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে টাকা নিয়ে ঢাকায় রওনা হই। হাসনাত আব্দুল্লাহ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে চট্টগ্রামে ফিরে আসি। এর পর থেকে ঢাকার সঙ্গে সমন্বয় করে মাঠ পর্যায়ে আন্দোলন শুরু হয়। তখন আমরা ২০ থেকে ২৫ জনের মতো ছিলাম।

শুরু থেকেই বাধা

প্রথম দিন থেকেই ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগ চাপ দিতে থাকে। ৩ জুলাই শহীদ মিনার ও চট্টগ্রাম খাগড়াছড়ি রোডে আন্দোলন করলে প্রক্টরিয়াল বডি ও সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের নেতারা হলে ডেকে হেনস্তা করে—মোবাইল চেক করে, শিবির ট্যাগ দেয়। এরপর আমি হল ছেড়ে দিই। ৫ জুলাই শহীদ মিনারে আন্দোলন শুরু করার কথা থাকলেও পরবর্তী সময়ে আমরা শহরে যাই। ১১ জুলাই বটতলী স্টেশনে কর্মসূচি ছিল। আন্দোলনকারী থেকে পুলিশ বেশি। সেদিন বোনদের সবাইকে পিটিয়েছিল পুলিশ। ২নং গেটের সামনে পেছনে সবাইকে পিটিয়েছিল। পুলিশ ছত্রভঙ্গ করলে একাই বুলেটের সামনে দোয়া পড়ে দাঁড়িয়ে যাই। সেদিন আন্দোলনে যাওয়ার আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিই, ‘যদি আমি শহীদ হয়ে যাই, তাহলে আমার লাশ রাস্তায় ফেলে রাখবেন, যখন শিক্ষার্থীরা বিজয় মিছিল নিয়ে ঘরে ফিরবে তখন দাফন করবেন।’

পুলিশের বুলেটের সামনে

সর্বপ্রথম আমি পুলিশের বুলেটের সামনে দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। এর পর থেকে সব জায়গায় শিক্ষার্থীরা পুলিশের বুলেটের সামনে দাঁড়াতে শুরু করে। সেদিন পুলিশের সামনে দুহাত উঁচু করে দাঁড়ানোর পর ধস্তাধস্তিতে সেন্সলেস হয়ে যাই। হাসপাতালে জ্ঞান ফিরে আসার পর ক্যাম্পাসে আসি। শত শত ভাইবোন আমাকে নিয়ে ক্যাম্পাসে উল্লাস করে। এটা আমাকে অনুপ্রেরণা দেয়। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চবি শাখার সভাপতি বাড়িতে ফোন করে বলেন, ‘আপনার ছেলেকে আন্দোলন থেকে ফেরান। না ফেরালে ছেলেকে পাবেন না। শুধু লাশ পাবেন।’ তবুও আমি ভয় পাইনি।

ছাত্রলীগের হামলা

১৪ জুলাই শিক্ষার্থীদের প্রতি শেখ হাসিনার ‘রাজাকার’ মন্তব্যের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসের জিরো পয়েন্টে আন্দোলনে যোগ দিই। ছাত্রলীগ আমাদের পিটিয়ে বের করে দেয়। ১৫ তারিখ শহরে কর্মসূচিতে যোগ দেয়ার জন্য শাটল ট্রেনে উঠলে ছাত্রলীগের নেতারা আমাকে শারীরিকভাবে আঘাত করতে শুরু করে। চবি সাংবাদিক সমিতির সদস্যরা তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে আমার সাহস বেড়ে যায়। সাংবাদিকরা কেউ সরেননি। তারা জোর করে ধরে প্রক্টর আমাকে অফিসে নিয়ে আসে এবং বারবার সাংবাদিকদের মোবাইল বন্ধ করতে চাচ্ছিল। প্রক্টরের সামনে রাজাকার ব্লেইম দিয়ে তারা আমার হাত থেকে জাতীয় পতাকা কেড়ে নেয়। সেসময় প্রক্টর নীরব ছিলেন। প্রক্টরের সামনে ছাত্রীদের নোংরা ভাষায় গালাগালও করে তারা।

কঠিন মুহূর্তে পাশে ছিলেন যারা

নেটওয়ার্ক যেদিন বিচ্ছিন্ন হলো সেদিন আমি ও রাসেল ভাই একই বাসায় থাকতে শুরু করি। দুজনে যে সিদ্ধান্ত নিতাম তা অন্যদের ফোন করে জানাতাম। রনি ভাই ও মাহিন ভাই পুরো আন্দোলনজুড়ে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। ৩ আগস্ট আন্দরকিল্লায় লাখো মানুষ জড়ো হয়। ব্ল্যাক আউট করে দিলে প্রবাসীরা আমাদের পাশে দাঁড়ান। তারা ফোনে ও ম্যাসেঞ্জারে বারবার বলতে থাকেন, ‘আপনারা ফ্যাসিস্ট হাসিনার কবল থেকে দেশকে স্বাধীন করেন। আমরা রক্ত বিক্রি করে দেশ গড়ে দেব।’ ৩ আগস্ট বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়ে আন্দোলনে যোগ দিই। ওই দিন আম্মাও ফোন করে আন্দোলনে যেতে বলেন। সেদিন মনে হয়েছিল, আমার আর কোনো চাওয়া নাই। শহীদ হওয়ার উদ্দেশ্যেই সেদিন বের হয়েছিলাম।

বিজয়ের দিন

৫ আগস্ট মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ছিল। ৪ তারিখ সারাদিন মাঠে ছিলাম। সামনে থেকে ও পেছন থেকে ছাত্রলীগ গুলি করছিল। সহযোদ্ধারা অ্যাম্বুলেন্সে করে আমাকে বের করে নিয়ে আসে। বাসায় গিয়ে আন্দোলনের ঘোষণা দিই। রাতে অ্যাডভোকেট রেজাউল ভাইয়ের সহযোগিতায় ট্রাকে করে মুজাহিদসহ ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিই। ঢাকায় যাওয়ার পথে ট্রাক আটকে দিলে সিনএজিতে ঢাকায় পৌঁছাই। সকাল ৮টায় শুনি শহীদ মিনারে কিছু মানুষ বের হলে পুলিশ গুলি করে। ৯টায় কিছু শিক্ষক রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে দাঁড়ালে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। ১১টার পর উত্তরা, শনির আখড়া ও যাত্রাবাড়ী থেকে মানুষ বের হয়। ১২টায় খবর পাই হাসিনা পালাবে। তবে বিশ্বাস হচ্ছিল না পালাবে। বৃদ্ধ থেকে বাচ্চা সবাই গণভবনের দিকে ছুটে যায়। সে এক অন্যরকম অনুভূতি।

অভ্যুত্থান-পরবর্তী মূল্যায়ন

শেখ হাসিনা পালানোর আগ পর্যন্ত পরবর্তী বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের কোনো রোডম্যাপ ছিল না। তবে পালানোর পর বিপ্লবী সরকার গঠন করা উচিত ছিল। এটা গঠন না করা একটা বড় ভুল বলে মনে করি। বিপ্লবী সরকার গঠন করার ইচ্ছা সারাদেশের মানুষের থাকলেও কেন গঠন করা হয়নি তা জানি না। ৫ আগস্টের পর কাউকে না জানিয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলো সেনানিবাসে বসেছিল। আসিফ ভাই ও নাহিদ ভাই কাউকে না জানিয়ে সেদিন ভুয়া তিন সমন্বয়ক সেনানিবাসে গিয়েছিল। বঙ্গভবনে যেদিন আমাদের ডেকেছিল, সেদিন ৯ জন সমন্বয়ক গিয়েছিলাম, তবে চুপ্পু সাহেব ছাত্র প্রতিনিধি রাখতেই চাচ্ছিলেন না।

আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ

রাজনৈতিক বিষয়সহ বিভিন্ন কারণে ঐক্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঐক্য ফিরিয়ে আনাই বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা রাষ্ট্রপতির অপসারণ এবং সংবিধান বাতিল করতে চাইলেও রাজনৈতিক দলগুলো চায়নি। জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে চাইলে সেটাও হয়নি। এদেশের ভাগ্য এখন পরিবর্তন করা না হলে কখন পরিবর্তন করা সম্ভব হবে, তা বলা দুষ্কর। দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মিলে যেসব সংস্কার দরকার বলে অনুভব করে, সেগুলো অবশ্যই করা প্রয়োজন। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা বারবার প্রতারিত হয়েছি। এখনো চতুর্মুখী ষড়যন্ত্র হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের মুরব্বিরা আমাদের অভিভাবক। আমাদের তাদের সন্তানের চোখে দেখা উচিত। ড. ইউনুস স্যার আমাদের জন্য আশীর্বাদ, তাকে আমাদের কাজে লাগানো খুবই প্রয়োজন। রাজনৈতিক সংকীর্ণতা থেকে বের হয় দেশের স্বার্থ আর একতা থাকলে এতদিন অনেক কিছু করা সম্ভব হতো।

স্বপ্ন যেমন

ছোটবেলা থেকেই চাইতাম দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে। আমৃত্যু দেশের মানুষের সঙ্গে থাকতে চাই, দেশের জন্য কাজ করতে চাই। আমি অনুভব করি বাংলাদেশের রাজনীতি নোংরা, এই নোংরা রাজনীতির প্রেক্ষাপট থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। এজন্য ভালো মানুষদের রাজনীতিতে আসতে হবে। না হয় আবারও খারাপ লোকেরা জায়গাগুলো দখল করবে। ব্যক্তিগতভাবে যেখানে অন্যায় হবে সেখানেই আমার কণ্ঠ জোরালো থাকবে। দেশের প্রতিটি নাগরিকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা উচিত। এই যে কথা বলার যাত্রাটা শুরু হয়েছে, তা যেন থেমে না যায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।