Image description
 

সরকারের বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)। এডিপির আকার মোট বাজেটের প্রায় ৪০ শতাংশ। কাজেই এডিপি বাস্তবায়নের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে বাজেটের সার্বিক বাস্তবায়ন। এবার এডিপি বাস্তবায়নের পরিস্থিতি বেশ হতাশাব্যঞ্জক। অর্থবছরের প্রথম আট মাস ২০২৪ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ২৪ দশমিক ২৭ শতাংশ, যা বিগত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন বাস্তবায়ন। এমনকি করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময়ও এত কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়নি।

 
 

এডিপি বাস্তবায়ন পরিস্থিতির ওপর গতকাল সোমবার হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। এতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন সংস্থার স্বঅর্থায়ন ছাড়া এডিপিতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি এবং প্রকল্প ঋণ ১ লাখ কোটি টাকা। এই বরাদ্দের মধ্যে অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সরকারের অংশে বাস্তবায়ন হয়েছে ৩৪ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের মাত্র ২১ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং প্রকল্প ঋণ ও অনুদান অংশে বাস্তবায়ন হয়েছে ২৭ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। এটি মোট বরাদ্দের ২৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। সার্বিকভাবে এডিপি ব্যয় হয়েছে ৬৭ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের মাত্র ২৪ দশমিক ২৭ শতাংশ।

 

গত ১৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসের এডিপি বাস্তবায়নের চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়নের হার সবচেয়ে কম। বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৩১ দশমিক ১৭ শতাংশ। তার আগের অর্থবছর এর হার ছিল ৩২ দশমিক ১০ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে করোনার ঠিক পরপর এ হার ছিল ৩৫ দশমিক ৮০ শতাংশ। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনা অতিমারির বছরেও প্রথম আট মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৩৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল ৩৭ দশমিক ২৬ শতাংশ। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরের একই সময়ে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল ৩৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল ৩৮ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। আর তার আগের অর্থবছর এটির হার ছিল ৩৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল ৩৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। তার আগের অর্থবছর এটির হার ছিল ৩৮ শতাংশ। এ ছাড়া ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩৬ শতাংশ, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৪৪ শতাংশ এবং ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৩৮ শতাংশ।

সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম আট মাসে মোটামুটি মোট এডিপি বরাদ্দের প্রায় ৩৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়ে যায়। কিন্তু এ বছর রেকর্ড সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা জানান, চলতি অর্থবছরের প্রথম দিন থেকেই কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। এর ফলে শুরু থেকেই এডিপি বাস্তবায়নে ধাক্কা লাগে। পরে কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার পতন আন্দোলনে রূপ নেয় এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এর ফলে অনেক প্রকল্প পরিচালক ও ঠিকাদার কাজ ফেলে পালিয়ে যান। এ ছাড়া সরকারের রাজস্ব আহরণেও বেশ শ্লথগতি পরিলক্ষিত হয়। ফলে প্রয়োজন অনুসারে বরাদ্দ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তা ছাড়া অপচয় রোধের লক্ষ্যে অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের বাস্তবায়ন কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। এর ফলে বাস্তবায়ন হ্রাস পায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মূলত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এডিপি বাস্তবায়ন হয়নি বললেই চলে। যার ধারাবাহিকতা দ্বিতীয় প্রান্তিকেও কিছুটা ছিল। যে কারণে বাস্তবায়ন কম হয়েছে। তা ছাড়া সরকার দুর্নীতি রোধকল্পে কিছু প্রকল্প স্থগিত করেছে। ফলে তারও একটি প্রভাব বাস্তবায়নে আছে। তবে এ বাস্তবায়ন কম হলেও অর্থনীতিতে তেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। কারণ যেসব প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোয় অপচয়ের সুনির্দিষ্ট নিদর্শন ছিল। তা ছাড়া প্রথমদিকে এমনিতে বাস্তবায়ন কম হয়। কারণ তখন বিল ছাড় কম থাকে। অর্থবছরের শেষদিকে বিল ছাড় বাড়ে। ফলে সে সময় বাস্তবায়ন হার বৃদ্ধি পায়।

মোট ৫৬টি সংস্থা এডিপি বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে বাস্তবায়নে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ। এ বিভাগের জন্য বরাদ্দ ৪ হাজার ৯৩৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ২০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের মাত্র শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশ। আর বাস্তবায়নে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সংস্থাটি ১৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বরাদ্দের বিপরীতে প্রথম আট মাসে বাস্তবায়ন করেছে ১২ কোটি ৮ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৭৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ।