
বিকেল ৪টা ৩০ মিনিট। রাজধানীর শাহবাগে অবস্থিত বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে ইফতারের আমেজ শুরু। হাসপাতালের বাইরে রোজাদার পথচারীরা তাড়াহুড়া করে ইফতারের ব্যবস্থা করছেন। ক্যান্টিন ও আশপাশের দোকানগুলোতেও ব্যস্ততা। কিন্তু ভেতরে জরুরি বিভাগ থেকে ওয়ার্ড— সব জায়গায় সময় যেন থমকে আছে। রোগীদের জন্য দৌড়ঝাঁপ করা চিকিৎসকদের হাতে নেই ইফতারের আয়োজন। ব্যস্ততার ফাঁকে এক চুমুক পানি আর এক খেজুরই যেন তাদের পরম পাওয়া
সিয়াম সাধনার মাস রমজানে রাজধানীসহ সারা দেশে জমে ওঠে ইফতারের হাট। উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্তের ইফতারে বাহারী আয়োজন থাকলেও হাসপাতালগুলোতে রোগী, স্বজন এবং চিকিৎসক-নার্সদের ইফতার যেন খুবই সাদামাটা।
গত ২০ দিন যাবৎ বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) মেডিসিনি বিভাগে ভর্তি আছেন জামালপুরের মো. শফিউল ইসলাম। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন রোজার পূর্বেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবেন এমন আকাঙ্ক্ষা থেকে। তবে ২০ দিন পেরুলেও ঈদের আগে বাড়ি ফিরতে পারবেন কিনা— এমন শঙ্কা তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে ভর্তিরত অবস্থায় একমাত্র সঙ্গী স্ত্রী শারমিন আক্তার। স্বামী শয্যাশায়ী হওয়ায় পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ যাবতীয় কাজ করতে হয় শারমিনকে একাই। যে কারণে রোজায় অন্যান্য সময়ের মতো ইফতার-সেহরি নিয়ে কোনো আকর্ষণ নেই এই দম্পতির।

শারমিন আক্তার বলেন, ২০ দিন হয়ে গেছে হাসপাতালে ভর্তি। প্রতিদিনই একটা-দুইটা পরীক্ষা করাতে হয়। রোজা রেখে সেগুলো নিয়ে দৌড়ে কোনো কূল পাই না, আবার কীসের ইফতার আর কিসের সেহরি? হাসপাতালে কোনোরকম দিনগুলো কাটাচ্ছি। প্রায় অধিকাংশ দিনেই পানি খেয়ে রোজা ভাঙতে হয়েছে। এরপর ভাত খেয়ে ফেলি।
তিনি আরও বলেন, ইফতারের সময় হাসপাতাল থেকে এক গ্লাস পানিও দেওয়া হয় না। সকাল-দুপুরে যে খাবার দেয় তা-ই অধিকাংশ রোগী ও সাথের মানুষজন খায়। কিন্তু অনেক সময় আবার সেই খাবারও নষ্ট হয়ে যায়। তখন বাইরে থেকে খাবার কিনে আনতে হয়। সেহরিতেও এভাবেই চলে।
শিশু হেমাটোলজি বিভাগে এক সপ্তাহ ধরে চিকিৎসাধীন শিশু খাইরুল ইসলাম। সঙ্গে আছেন বাবা রফিকুল ইসলাম এবং মা সুরমা আক্তার। প্রতি বছর রোজায় বাহারী আয়োজনে ইফতার-সেহরির মধ্যদিয়ে রোজা পালন করলেও এবার ভিন্ন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি এই দম্পতি।
রফিকুল ইসলাম বলেন, ইফতারে গত ১৫ থেকে ১৬ দিনে মাত্র দুইদিন মুড়ি-ছোলাসহ ভিন্ন কিছু খাওয়া হয়েছে। বাকি দিনগুলোতে পানি দিয়ে রোজা ভেঙে সরাসরি ভাত খাওয়া হয়। মোটামুটি সব রোগী ও স্বজনদের একই চিত্র। কেউই আলাদা করে ইফতার-সেহরি করেন না।

তিনি বলেন, প্রায় সময়েই আত্মীয়-স্বজন খাবার দিয়ে যায়, সেটা ইফতারির পর খাওয়া গেলেও সেহরিতে আর খাওয়া যায় না। যে কারণে সেহরির আগে ক্যান্টিন থেকে সিরিয়াল ধরে গিয়ে খাবার কিনে আনতে হয়। আমাদের কাছে এই মুহূর্তে ইফতার-সেহরি নিয়ে আলাদা কোনো আকর্ষণ নেই। কোনোভাবে রোগীকে সুস্থ করে বাসায় ফেরাতে পারলেই আলহামদুলিল্লাহ।
রোজায় ইফতার-সেহরিতে রোগী-স্বজনদের যেমন সাদামাটা চিত্র দেখা যায়, একই রকম চিত্র চিকিৎসক-নার্সদের ক্ষেত্রেও। অন্যান্য দিনগুলোর মতো কর্তব্যরত চিকিৎসকদের হাতে স্যালাইনের সিরিঞ্জ বা প্রেসক্রিপশন লেখা কাগজ। এরই মাঝে দৌড়ে গিয়ে একটা খেজুর বা এক চুমুক পানি— এই হলো তাদের ইফতার।
ডা. ফয়সাল বলেন, বাসায় ইফতার করলে যেমন আলাদা একটা আমেজ থাকে, হাসপাতালে আসলে ইফতারের কোনো খবরই থাকে না। অনেক সময় আজান হয়ে গেলেও টের পাওয়া যায় না। আজানের শব্দ তো ভেতরে আসেই না। ফ্রি থাকলে মোবাইলে সময় দেখে ইফতার করা হয়। অধিকাংশ সময় একটু পানি আর খেজুর মুখে দিয়ে আবার কাজে ফিরতে হয়।
তিনি বলেন, রোগীদের সেবাই আমাদের প্রথম দায়িত্ব। এখানে বিলাসিতা করার সুযোগ নেই। হাতের কাজটা শেষ করেই পরে ইফতার করি। মাঝেমধ্যে এমন হয় যে ইফতার করতে বসলে রোগীর ডাক আসে, তখন ইফতার ছেড়েই চলে যাই।
চিকিৎসকদের জন্য আলাদা কোনো ইফতার ব্যবস্থা আছে কি না— জানতে চাইলে ডা. ফয়সাল বলেন, হাসপাতালের পক্ষ থেকে কোনো আয়োজন থাকে না। আমরা নিজেরাই ইফতার ব্যবস্থা করি। যারা ডিউটিতে থাকি তারা কিছু টাকা দিয়ে আগে থেকেই রেডি করে রাখার চেষ্টা করি।
হাসপাতালে কর্মরত জান্নাতুন নাঈম নামে এক নার্স বলেন, হাসপাতালে থাকলে নামমাত্র ইফতার করা হয়। বেশি কিছু করার অবশ্য কোনো সুযোগও থাকে না। রোগীরা তো ইফতারের সময় দেখে আসে না। রোগী এলে তখন আর ইফতার করছি কি করি নাই, সেসব দেখার সুযোগ নেই। অনেক সময় এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার রোগী দেখতে ছুটতে হয়। এটাই আমাদের রোজার বাস্তবতা।

রোগী-স্বজনদের ইফতার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নোমান মোহাম্মদ মুছলেহ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতালগুলোতে আসলে রোগীদের জন্য ইফতার সেহরিতে আলাদা কিছুই করা হয় না। কারণ হাসপাতালে যারা আসেন, তারা রোগী হিসেবেই আসেন এবং ভর্তি হন। হাতেগোনা কয়েকজন হয়তো রোজা রাখতে পারেন, বাকি প্রায় সব রোগীই রোজা রাখতে সক্ষম নন। যে কারণে খাবার ব্যবস্থাপনায় কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব হয় না। যে কয়েকজন রোজা রাখেন, তারা নিজস্ব ব্যবস্থাপনাতেই ইফতার-সেহরি করেন।
তিনি বলেন, অন্যান্য সময়ের মতো আমরা এবারও হাসপাতাল সিস্টেমেই খাবার দিচ্ছি। সকালে রোগীদের জন্য ডিম, কলা-পাউরুটি থাকে। দুপুরে মাছ এবং রাতে মাংসজাতীয় খাবার থাকে। কেউ কেউ হয়ত সকাল ও দুপুরের খাবারটাই ইফতারের জন্য রেখে দেন, আবার রাতের খাবারটা সেহরিতে খান। এটা রোগীদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়।
হাসপাতালের পরিচালক আরও বলেন, রাত ১১টা পর্যন্ত হাসপাতালের ক্যান্টিন খোলা থাকে, আবার সেহরিতেও খোলা থাকে। রোগীদের সঙ্গে যে স্বজনরা হাসপাতালে থাকেন, তারা সাধারণত ক্যান্টিন থেকেই খাবার সংগ্রহ করে ইফতার-সেহরিতে খেয়ে থাকেন।
ইফতার-সেহরিতে চিকিৎসক-নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সাদামাটা ইফতার প্রসঙ্গে এই কর্মকর্তা বলেন, চিকিৎসক-নার্সসহ কোনো স্বাস্থ্যকর্মীর জন্যই ইফতার-সেহরি বাবদ মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা কোনো বরাদ্দ থাকে না। যে কারণে হাসপাতালে তাদের জন্য বিশেষ কোনো আয়োজনের সুযোগ নেই। প্রত্যেকেই নিজ নিজ ব্যবস্থাপনায় ইফতার-সেহরি করেন। তবে ঈদের লম্বা ছুটির সময় যারা ডিউটি করেন, তখন তো আশপাশের হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ থাকে, তাই সেই সময়ের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা একটা বরাদ্দ থাকে। তখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আলাদাভাবে খাবারের আয়োজন করে।