Image description
ক্রমাগত দখলে সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে বুড়িগঙ্গা নদী। এছাড়া শিল্প কারখানা ও সুয়ারেজের বর্জ্যে সয়লাব এর পানি
  • ঠুঁটো জগন্নাথ নদী কমিশন
  • ৮ মাস ধরে চেয়ারম্যান নেই

নদীরক্ষা কমিশন এখন ঠুঁটো জগন্নাথ। বিগত আট মাসের বেশি সময় ধরে কমিশনে নেই চেয়ারম্যান। ফলে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে দেশের সব নদ-নদী। স্বৈরশাসক হাসিনা সরকারের পতনের পর ফের শুরু হয়েছে নদী দখল। ফলে উদ্ধার বা নিয়ন্ত্রণ তো দূরে থাক দখলমুক্ত নদীগুলো নতুন করে দখলের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

যদিও নদী বিনাশী প্রকল্পের কারণে ইতোমধ্যে দখল-দূষণে প্রাণ হারিয়েছে দেশের শতাধিক নদী। আর জীবিত যে নদীগুলো রয়েছে তার মধ্যে নাব্য সঙ্কটে রয়েছে ৯০ ভাগ। গবেষণা বলছে বর্তমানে দেশে এক হাজার আটটি নদী থাকলেও শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত শতভাগ নদী এখন দখল ও দূষণের শিকার। ফলে বর্তমান অবস্থায় বাকি নদীগুলোও রক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও পরিবেশ ও ভূমি মন্ত্রণালয় আছে। কিন্তু তাদের নদী রক্ষায় দায়িত্ব না দিয়ে নদী দখলে অভিযুক্ত নৌ মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া দখলদারদের পূর্ণ তালিকা তৈরিতে ব্যর্থতা, নদী রক্ষা ও দখল দূষণে কোনো কমিশনও গঠিত হয়নি। ফলে নদী রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থার ব্যর্থতায় বর্তমানে দেশজুড়ে অপ্রতিরোধ্য অবস্থায় নদী দখল শুরু হয়েছে। এমতাবস্থায় শক্তিশালী ও স্বাধীন বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশন বাস্তবায়নে লোকবল নিয়োগ ও দোষীদের শান্তি প্রদানে আইনগত ক্ষমতা প্রয়োগের বিধান রেখে আইন সংস্থারের দাবি জানিয়েছেন তারা।

নদীরক্ষা কমিশন সূত্র জানায়, হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে নদীরক্ষা কমিশনে তাদের কোনো চেয়ারম্যান নেই। ফলে আপাতত নদী রক্ষায় সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এ সুযোগে দখলদার প্রভাবশালীরা আবারো তৎপর হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক ও অর্থিক প্রভাব খাটিয়ে নতুন করে তারা নদী দখলে নেমেছে। ফলে এক দিকে যেমন আগে দখলমুক্ত নদীগুলো ফের দখল চলছে, তেমনি আগে দখল হয়নি এমন নদীও নতুন করে দখল হচ্ছে।

পরিবেশবাদী একাধিক সংস্থার তথ্যমতে, সারা দেশে বর্তমানে এক হাজার আটটি নদী থাকলেও তার শতকরা ৯০ ভাগ নদী নাব্য সঙ্কটে ভুগছে। আর শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত শতভাগ নদী দখল ও দূষণের শিকার। এরমধ্যে বিলীন হয়েছে শতাধিক। ক্ষমতার সাথে জড়িত প্রভাবশালী ও রাজনীতিবিদদের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে নদীর দখলবাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে।

পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলন তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে বলছে, বর্তমানে ঢাকা বিভাগে ১৬৮টি, বরিশাল বিভাগে ৯০টি, খুলনা বিভাগে ১২৪টি, রাজশাহী বিভাগের ১১০টি, রংপুর বিভাগে ২৬৮টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ১৩৫টি ও সিলেট বিভাগে ৩৭টি নদী রয়েছে। এর মধ্যে সারা দেশে ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার নদীপথে জলরাশি প্রবাহিত হয়েছে। কিন্তু সঠিক তদারকির অভাবে নদীগুলো বিলীন হতে চলেছে।

বিরাজমান পরিস্থিতিতে নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হওলাদার নয়া দিগন্তকে বলেন, নদী রক্ষা কমিশনকে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করা হয়েছে। নদী জনগণের সম্পদ থাকার পরও দখলদারদের বিরুদ্ধে সরকার দীর্ঘ দিন ধরে কোনো অ্যাকশনে যাচ্ছে না। এতদিন রাজনৈতিক সরকার ছিল, তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বর্তমান সরকার আসার পর নদী রক্ষা কমিশনে এখন কোনো চেয়ারম্যান নেই। মেম্বার যাদের নেয়া দরকার তাদেরও নেয়া হয়নি।

তার ভাষ্য, পরিবেশ নিয়ে কাজ করে এমন অনেক সংগঠন আছে। রয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয় আছে। নদী রক্ষায় দায়িত্ব দেয়া উচিত ছিল তাদের; কিন্তু এদের দায়িত্ব না দিয়ে দেয়া হয়েছে নৌ মন্ত্রণালয়কে। অথচ নদী দখলে এই নৌ মন্ত্রণালয়ই অপরাধী। এখনো দখলদারদের পূর্ণ তালিকা তৈরি হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চলে গেলে তার জন্য কমিশন হয়; কিন্তু দেশের জনগণের সম্পদ রক্ষায় কোনো কমিশন হয় না। অথচ পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণে নদী খুব প্রয়োজন। এ ছাড়া আগেই যেখানে নদীগুলোর দখল উচ্ছেদ হয়নি সেখানে বর্তমান অপ্রতিরোধ্য অবস্থায় নদী দখল চলছে। এমতাবস্থায় শক্তিশালী কমিশন ছাড়া নদী রক্ষা অসম্ভব।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খানের ভাষ্য, বিগত সরকারের সময় অনেক এমপি, উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তি নদী দখলের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এ জন্য তখন নদী রক্ষায় সফল হওয়া যায়নি। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো নতুন বাংলাদেশে এসে এখন আমারা এই দখল বন্ধ করতে পারি নি। বরং নদী-খাল দখল আরো বেড়েছে! এটা একটা ফ্যাক্ট। কারণ গণ-অভ্যুত্থানের পরে আমরা রাষ্ট্রের দখলদারদের সেই বার্তাটা দিতে পারিনি যে নদীর মতো জীবন্ত সত্তাকে আপনারা ‘ধর্ষণ’ করেছেন। এ ব্যর্থতার ফল এখন দেখতে হচ্ছে।

এ দিকে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমাদ কামরুজ্জামান মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রথমত আইনের কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন।

দোষীদের শাস্তি প্রদানে আইনগত ক্ষমতা প্রয়োগের বিধান রেখে আইন সংস্থারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, শক্তিশালী ও স্বাধীন বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশন বাস্তবায়নে লোকবল নিয়োগ, জলাশয় ভরাট বন্ধে দেশের সব জলাশয় চিহ্নিতকরণ, সীমানা নির্ধারণ ও খননের উদ্যোগ নেয়া উচিত। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে সব নদীর উপর থেকে বাঁধ অপসারণ করা জরুরি। এর বাইরে নদীর নাব্য সঙ্কট দূরীকরণে নতুন বাজেট প্রণয়নের মাধ্যমে অনতিবিলম্বে সারা দেশের নদী খনন ও সব নদীর সীমানা নির্ধারণ ও অবৈধ দখলদারিত্ব উচ্ছেদ প্রয়োজন।