Image description

প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্বাধীন পুলিশ কমিশনের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছেন পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। পুলিশ বাহিনীকে সেবামুখী করতে এবং পুরোপুরি সঠিক ধারায় ফেরাতে এ কমিশন প্রয়োজন বলে জানান তাঁরা। পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বাধীন অথবা স্বশাসিত কমিশন এই সময়ে গঠন করতে না পারলে পুলিশ তার পুরোনো নেতিবাচক চরিত্রে ফিরে যাবে—এমন আশঙ্কার কথাও জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

আজ সোমবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে পুলিশ বাহিনী পরিচালনায় বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, দাবি ও আশঙ্কার কথা তুলে ধরেন পুলিশ কর্মকর্তারা। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে অংশ নেওয়া ১১ জন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

ওই বৈঠকে জেলা পুলিশ সুপার (এসপি), রেঞ্জ ডিআইজি (উপমহাপরিদর্শক), মহানগর পুলিশ কমিশনার, সব ইউনিটের প্রধান, সব অতিরিক্ত আইজিপি অংশ নেন। ১২৭ জন কর্মকর্তার উপস্থিত থাকার কথা ছিল বৈঠকে। এমআরটি পুলিশের ডিআইজি ছাড়া বাকি সব কর্মকর্তাই সভায় ছিলেন। সভায় পুলিশের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবিব ও রাজশাহীর পুলিশ সুপার (এসপি) ফারজানা ইসলাম।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, আগামী প্রজন্মকে সুরক্ষিত রাখতে পুলিশকে সঠিক ধারায় ফেরানোর এখনই উপযুক্ত সময়। এ সময়ে যদি পুলিশের মৌলিক সংস্কার না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে পুলিশ আবার আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের মতো ফ্যাসিস্টের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে।

চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবিব তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, এখন ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণ। এখনই যদি পুলিশ কমিশন গঠন করা না হয়, তাহলে কোনো দিনই হবে না। পুলিশ কমিশন সব পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের দাবি। ডিআইজি আরও বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মানুষ সংস্কারের কথা বলছে। আর পুলিশ বাহিনী নিজেরাই নিজেদের সংস্কারের কথা তুলে ধরছে। কিন্তু পুলিশের সংস্কারের কথা কেউ সেভাবে শুনছে না।

পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশে ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন’ গঠনের বিষয়টি সুস্পষ্ট না আসায় বাহিনীটির সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। ঐকমত্য কমিশনে পুলিশ সংস্কারের প্রসঙ্গটি না রেখে, ‘প্রশাসনিক ব্যবস্থার’ সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগে এই ক্ষোভ বাড়ে। এসব বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টাকে বিস্তারিত বলতে চেয়েছিলেন কর্মকর্তারা। কিন্তু বৈঠকে আটজন পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য দেওয়ার কথা থাকলেও আইজিপিসহ মাত্র তিনজন বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পান।

তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে আয়োজিত বৈঠকে পুলিশ কর্মকর্তারা। ঢাকা, ১৭ মার্চ
তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে আয়োজিত বৈঠকে পুলিশ কর্মকর্তারা। ঢাকা, ১৭ মার্চছবি: প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

বৈঠকে অংশগ্রহণকারী পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ জন্য প্রধান উপদেষ্টার কাছে সব সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরতে পারেননি। তাই অনেকের মধ্যে আক্ষেপ রয়েছে।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল এমন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক নিয়ে পুলিশে বাড়তি উচ্ছ্বাস ছিল। সবাই চেয়েছিল সমস্যার কথাগুলো প্রধান উপদেষ্টাকে বলবেন। সেভাবে বিষয়ভিত্তিক প্রেজেন্টেশনও তৈরি করা হয়েছিল। তবে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ না পাওয়ায় মৌলিক সমস্যাগুলো তুলে ধরা যায়নি।

বৈঠকে উপস্থিত কয়েকজন পুলিশ সদস্য জানান, প্রধান উপদেষ্টা বৈঠকে জেলার আইনশৃঙ্খলা নিয়ে একটি মূল্যায়নের কথা বলেছেন। এটি এমন হবে যে জেলা পুলিশের যাঁরা ওই মূল্যায়নে ভালো করবেন তাঁদের পুরস্কৃত করা হবে। ভালো পদে পদায়নের ক্ষেত্রে তাঁদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। জেলা পুলিশের দক্ষতা মূল্যায়ন করার বিষয়ে তিনি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন।

এসেছে আরও সমস্যার কথা

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে পুলিশের নানা সমস্যার কথা উঠে এসেছে। এর মধ্যে আবাসন, যানবাহন ও কর্মপরিবেশের বিষয়টি বিশেষভাবে প্রাধান্য পেয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় এই সমস্যাগুলো বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে বলেও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। নারী পুলিশের সদস্যসংখ্যা বাড়ানো এবং তাঁদের সন্তানদের জন্য ‘ডে–কেয়ার’ চালুর দাবিও জানানো হয় বৈঠকে।

রাজশাহীর পুলিশ সুপার (এসপি) ফারজানা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশের আবাসন সমস্যা এবং নারী পুলিশ সদস্যদের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের কথা প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছি। কনস্টেবল থেকে উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের আবাসন–সংকটের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে। দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্য বিশেষ করে নারী ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের জন্য বিশুদ্ধ পানি এবং শৌচাগার সমস্যার সমাধানের প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরেছি।’

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের কারণে পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গায় চিড় ধরেছিল বলে বক্তব্যে উল্লেখ করেন আইজিপি। তিনি বলেন, এর ফলে পুলিশি ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের অসন্তোষ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। ৫ আগস্ট থেকে আজ পর্যন্ত পুলিশের সদস্যরা অনেকবার উচ্ছৃঙ্খল জনতার আক্রমণের শিকার হয়েছে।

অপরাধীরা এ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হচ্ছে। তা ছাড়া আন্দোলনে পরাজিত শক্তির ইন্ধনেও নানা ধরনের অপরাধ হচ্ছে।
আইজিপি বলেন, যেসব পুলিশ সদস্য ফ্যাসিবাদী সরকারের হয়ে দমন–পীড়ন, গুম–হত্যা ইত্যাদিতে জড়িত ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন মামলায় সুনির্দিষ্টভাবে জড়িত ১৩৬ জন পুলিশ সদস্যের মধ্যে ৮২ জনকে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে।

আইজিপি দাবি করেন, গত সাত মাসে সংঘটিত অপরাধ পর্যালোচনায় দেখা যায়, অল্প দু–একটি ক্ষেত্রে অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পুলিশ সদর দপ্তরে যান। সেখানে সারা দেশের পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে আরও সতর্ক ও আন্তরিক হওয়ার নির্দেশনা দেন আইজিপি বাহারুল আলম।