
শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের লক্ষ্যে গেল বছর জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অভূতপূর্ব ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছিল। ঐক্যবদ্ধ এই প্রতিরোধের জোয়ারে টানা ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছিল। বাংলাদেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। কিন্তু ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে ছয় মাস পার না হলেই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি ও বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী রোডম্যাপ, সংস্কারপ্রক্রিয়া, গণপরিষদের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন প্রভৃতি ইস্যুতে ভিন্নমত পোষণ করছে। এরই মধ্যে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেজ বাংলাদেশে এসে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে জাতীয় সংলাপে সহযোগিতা দেয়ার কথা বলেছেন। তবে কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ঐকমত্যে পৌঁছানোর মূল কাজটি বাংলাদেশকেই করতে হবে। জাতিসঙ্ঘ এতে সহায়তা ভূমিকা রাখতে পারে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির গতকাল নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছানের একটি প্রক্রিয়া অন্তর্বর্তী সরকার চলমান রেখেছে। রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সাথে আলোচনায় বসায় একটি পরিকল্পনা সংস্কার কমিশনগুলোর রয়েছে। এই আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো একটি ঐকমত্যের দিকে যাবে এটা আমরা আশা করি। বিভিন্ন ইস্যুতে নানা পক্ষের সাথে সংলাপের মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছানের চেষ্টা করার অভিজ্ঞতা জাতিসঙ্ঘের রয়েছে। এই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সাথে তারা শেয়ার করতে পারে, যা আমাদের কাজে আসবে। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব এক্ষেত্রে সহায়তা দেয়ার প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন। তবে ঐকমত্যে পৌঁছানের মূল কাজটা আমাদেরই করতে হবে। এতে জাতিসঙ্ঘ সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি বড় অংশ আরাকান আর্মির দখলে থাকায় জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব মানবিক করিডোরের বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের সাথে প্রাথমিক আলোচনা করেছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে মানবিক সহায়তা রাখাইনে পৌঁছাতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর অনুমোদন ও সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। এই বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন- প্রশ্ন করা হলে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, আমি এটাকে ইতিবাচকভাবে দেখতে চাই। বর্তমানে রোহিঙ্গাদের নিয়ে দু’টি সমস্যা চলছে। একটি হল বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন। যা একটি পুরনো ইস্যু। এর পাশাপাশি রাখাইনে যুদ্ধাবস্থা নতুন সমস্যার সৃষ্টি করেছে। মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে আরাকান আর্মির সঙ্ঘাতের কারণে রাখাইনের বেসামরিক জনগোষ্ঠী একটি দুর্ভিক্ষ অবস্থায় পড়েছে। এই দুর্ভিক্ষ থেকে মানুষ পালিয়ে বাঁচতে চাইবে। সীমান্তবর্তী দেশ হওয়ায় বাংলাদেশে তাদের নতুন করে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে রাখাইনে রেখেই যদি মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেয়া যায়, তবে তাদের বাংলাদেশের দিকে আসার প্রবণতা ঠেকানো যেতে পারে। তিনি বলেন, মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতার কারণে বিশেষ করে উত্তর রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর একমাত্র পথ বাংলাদেশ। এ কারণেই জাতিসঙ্ঘ বিষয়টি উত্থাপন করেছে। তবে জাতিসঙ্ঘের এই প্রস্তাবের সাথে বাংলাদেশ সরকার, মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মিকে সহমত পোষণ করতে হবে। তবেই তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
মানবিক করিডোর চালু হলে মিয়ানমারে অবস্থানরত রোহিঙ্গদের জন্য বাংলাদেশে চলে আসার সুযোগ সৃষ্টি হবে কিনা- এমন আশঙ্কা প্রসঙ্গে বিইআই প্রেসিডেন্ট বলেন, রাখাইন থেকে কেউ বাংলাদেশে আসবে না - এই শর্ত মানবিক করিডোরের টামর্স অব রেফারেন্সে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজন রয়েছে।
বাংলাদেশ সফরের সময় রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক সহায়তা বাড়ানোর যে আহ্বান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব করেছেন তা কতটুকু সফলতা পেতে পারে- জানতে চাইলে সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, কতটা সফলতা পাবে তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল, তবে এর প্রয়োজনীয়তা যে রয়েছে তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বাংলাদেশের আশ্রয় নেয়া বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর খাবারসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা মেটাতে যে অর্থের প্রয়োজন, তা কোনো না কোনো উৎস থেকে আসতে হবে। এ জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার কোনো বিকল্প নেই। আর জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব এ ধরনের আহ্বান জানানোর সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি। উনার এই আবেদন খুবই সময় উপযোগী। আমরা এখন এটিকে ভিত্তি করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারি।