
বাংলাদেশে চারদিনের সফর শেষ করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। এর আগেও তিনি বাংলাদেশ সফর করেছেন। ২০১৮ সালের ওই সফর আর ২০২৫ সালের সফরের তাৎপর্য আলাদা। কারণ এবার তিনি এমন এক সময় বাংলাদেশ সফর করেছেন যখন বাংলাদেশ একটি পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে দীর্ঘ ১৬ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসক শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। আর ২০১৮ সালে তিনি যখন সফর করেছেন তখন এদেশে গণতন্ত্র সুসংহত ছিল না। অ্যান্তোনিওগুতেরেসের এবারের সফর রোহিঙ্গা সংকট অগ্রাধিকার থাকলেও নতুন বাংলাদেশের রূপান্তরে আগামী দিনে বৈশ্বিক প্ল্যাটফরমটির ভূমিকা কী হবে সেটিও বুঝার চেষ্টা ছিল। এ ছাড়া তার এই সফর চলমান সংস্কার প্রক্রিয়াসহ কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বিশেষ বার্তা রয়েছে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
জাতিসংঘ মহাসচিব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার কার্যক্রম বোঝার চেষ্টা করেছেন। বুঝতে চেয়েছেন সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান। একইসঙ্গে তিনি সংস্কার, নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আস্থাবোধ ও ঐকমত্যের ওপর জোর দিয়েছেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দল ও কমিশন প্রধানদের সঙ্গে হওয়া এমন একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজক যখন খোদ ঢাকার জাতিসংঘ অফিস তখন বোঝা যায় সংস্কারে সংস্থাটির আগ্রহ রয়েছে। একই সঙ্গে জাতিসংঘের গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে রাজনৈতিক মহলে। সংস্থাটির মহাসচিব বলেছেন, নতুন বাংলাদেশে সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সেখানে প্রধান সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত আছে জাতিসংঘ। তার সফর বাংলাদেশের সংস্কার প্রক্রিয়া ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে সফল করতে সাহায্য করবে। অন্যদিকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও সমাধান খুঁজেছেন তিনি। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক সহায়তা কমে গেলে যে মানবিক সংকট তৈরি হবে সেটিও তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। অ্যান্তোনিওগুতেরেস বলেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান। এদিকে জাতিসংঘ সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দল ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে যে বৈঠক করেছেন তা নিয়ে কিছুটা অস্বস্তিতে আছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তিনি গোলটেবিলটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি। অন্যদিকে জামায়াত, নতুন দল এনসিপিসহ উপস্থিত সাত দলের অনেকে বৈঠকে সংস্কারকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় দলীয় বক্তব্য রেখেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মানবজমিনকে বলেন, আমাদের জাতীয় পর্যায়ে যে রূপান্তর বা সংস্কার হচ্ছে তা সম্পর্কে সবার সঙ্গে কথা বলে বাস্তব চিত্র অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। একই সঙ্গে তিনি এ সংস্কার কার্যক্রমকে সমর্থন করেছেন। বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক, মানবিক, টেকসই, ন্যায়সঙ্গত সমাজ বিনির্মাণের উদ্যোগে জাতিসংঘের সমর্থনের কথা জানিয়েছেন। বাংলাদেশের নতুন অগ্রযাত্রায় জাতিসংঘ কাজ করতে আগ্রহী। কারণ এ সংস্কার উদ্যোগের একটি ভালো উদ্দেশ্য আছে। জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশে ন্যায়সঙ্গত, বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক সমাজের যে পরিবর্তন হচ্ছে সেটিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। একই সঙ্গে জাতিসংঘের পাশাপাশি তিনি এ যাত্রায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও বাংলাদেশের প্রতি সমর্থনের আহ্বান জানিয়েছেন। এটি এদেশের সরকার ও মানুষের জন্য অবশ্যই ইতিবাচক। তিনি বলেন, দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গদের নিয়ে তিনি ইতিবাচক একটি অবস্থান নিয়েছেন। এখানে যে আর্থিক ঘাটতি দেখা দিচ্ছে সেটিকে তিনি সবার সামনে এনেছেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনের কথা বলেছেন। এ ছাড়া আমাদের দেশের পাশাপাশি মিয়ানমারেও যে রোহিঙ্গারা রয়েছে তাদের সহায়তার জন্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সহায়তা দেয়ার কথা বলেছেন। হুমায়ুন কবির বলেন, সব মিলিয়ে তিনি আমাদের সংস্কার ও রূপান্তরের ক্ষেত্রে একাত্মতা পোষণ ও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে জাতিসংঘের সমর্থনের কথা জানিয়ে গেছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও সমর্থন চেয়েছেন। ঢাকার জাতিসংঘ অফিস গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজনের মাধ্যমে সংস্কারে সরাসরি যুক্ত হলো কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, গোলটেবিল বৈঠক জাতিসংঘ আয়োজন করেছে ঠিক। কিন্তু পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে উনার পরবর্তী বক্তব্যে সংস্কার কার্যক্রমের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতা করতে চান এমনটাই মনে হয়েছে।
এদিকে ঢাকায় সফরের তৃতীয় দিনে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সঙ্গে নিয়ে যৌথ প্রেস ব্রিফিং করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিওগুতেরেস। সেখানে তিনি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, সংস্কার ও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট করেন। বলেন, নতুন বাংলাদেশে সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সেখানে প্রধান সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত আছে জাতিসংঘ। একই সঙ্গে তার বক্তব্যে সফরের উদ্দেশ্যও উঠে এসেছে। যেখানে রোহিঙ্গাদের প্রতি তার সমর্থন ও সহমর্মিতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাংলাদেশ থেকে মানবিক সহায়তা চ্যানেল চালু করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে। সংস্কার নিয়ে তিনি বলেন, এটি বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ উভয়ের জন্য একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফর বাংলাদেশের সংস্কার প্রক্রিয়া ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে সফল করতে সাহায্য করবে। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। আমি জনগণের গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের প্রত্যাশাকে স্বীকার করি। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে পরিস্থিতির প্রসঙ্গ টেনে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, এটি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের উচিত আপনাদের ন্যায়সঙ্গত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে সমর্থন জোগানো। অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার ইস্যুতে বাংলাদেশ জাতিসংঘকে প্রধান সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করতে পারে বলেও স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। বলেন, বাংলাদেশ এখন ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমি নিশ্চিত করতে চাই যে, শান্তি বজায় রাখতে জাতিসংঘকে বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণের এক নম্বর সহযোগী হিসেবে গণ্য করতে পারেন আপনারা। আমরা সবার জন্য একটি ন্যায্য এবং টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে চাই।
অন্যদিকে আগামী মাস থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা কমে গেলে ভয়াবহ মানবিক সংকট তৈরি হবে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন জাতিসংঘ মহাসচিব। বলেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান। বর্তমান পরিস্থিতি হলো, মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং আরাকান আর্মির মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলছে। এই পরিস্থিতিতে অবিলম্বে এবং সম্মানজনকভাবে প্রত্যাবর্তন অত্যন্ত কঠিন হবে, তা স্পষ্ট। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আরাকান আর্মিকেও আলোচনায় যুক্ত করা উচিত বলে মনে করেন জাতিসংঘ মহাসচিব। তিনি বলেন, আরাকান আর্মিও এখন একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমি মনে করি তাদের সঙ্গেও প্রয়োজনীয় সংলাপ হওয়া উচিত। কারণ আমরা জানি যে অতীতে রাখাইন এবং রোহিঙ্গা সমপ্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক সহজ ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, এই সফরে জাতিসংঘ মহাসচিব উপলব্ধি করেছেন যে রোহিঙ্গারা তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে কতোটা মরিয়া। তারা তাদের পরিচয়, অধিকার ও সম্মানজনক জীবন উপভোগ করতে চায়। তাই এ সংকটের সমাধান সীমান্তের অন্য পাড়ে রয়েছে। ওখানে সবগুলো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। কারণ মিয়ানমারে এখন ভিন্ন একটি বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। তাই আমাদের সব পক্ষকেই রাজি করাতে হবে যাতে রোহিঙ্গার নিশ্চিন্তে রাখাইনে ফিরে যেতে পারে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. নুরুল আমিন বেপারী মানবজমিনকে বলেন, সমালোচকরা জাতিসংঘকে বলে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংগঠন। আর ন্যাটোকে বলে সামরিক সংগঠন। দু’টা প্রতিষ্ঠানই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে বিশ্বব্যাপী। যুক্তরাষ্ট্রও এ দু’টি সংগঠনকে প্রেট্রোনাইজ করে। তাই জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ অন্তত বাংলাদেশের পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে দেশে গণতন্ত্র যখন বিপণ্ন তখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের পরামর্শেই বিএনপি ৩১ দফা দিয়েছে। তাই রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে পশ্চিমাদের উদ্যোগ নতুন কিছু নয়।
তিনি বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব আসার আগে এখানে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম ঘুরে গেছেন। সফরকালে তিনি বলেছেন ১/১১ এর সময় যুক্তরাষ্ট্র এখানে ভুল করেছে। এর মতো আর ভুল করবে না। মূলত এর মাধ্যমে তারা সরকারের সংস্কারকে সমর্থন করলো। এরপর জাতিসংঘ মহাসচিব এসেছেন একই উদ্দেশ্যে। মির্জা ফখরুল ইসলাম সাহেব বলেছেন, তিনি ঠিক বুঝতে পারেননি। তাকে বুঝতে হবে। কারণ আওয়ামী লীগও যুক্তরাষ্ট্রের এসব কার্যক্রম একটা সময়ে বুঝতে পারেনি। বা বোঝার চেষ্টা করেনি। একটা জিনিস বুঝতে হবে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন হলে সেখানে বিএনপিই সংখ্যাঘরিষ্ঠতা পাবে। তাই বিএনপিকে পজেটিভ রাজনীতি করতে হবে। আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের প্রতি দুর্বল হলে চলবে না। কারণ ’২৪-এর অভ্যুত্থান বৃথা গেলে দেশ সঠিক পথে চলবে না। বিএনপিকে সেটি বুঝতে হবে। আওয়ামী লীগের স্প্রিট না ’২৪-এর স্প্রিটের সঙ্গে চলতে হবে। গোলটেবিল বৈঠকের মাধ্যমে জাতিসংঘ নিজেদের এদেশের সংস্কার কার্যক্রমে যুক্ত করে ফেলেছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই যুক্ত করে ফেলেছে। আগামীতে যদি কোনো সংকট দেখা দেয় তখন তারা আরও গভীরভাবে এতে যুক্ত হবে। এটি বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক একটি পথে পরিচালিত করতে কাজ করবে। যেটি স্টেট ডিপার্টমেন্টের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার অংশ।