Image description
“সাড়ে ৬ হাজার টাকার সয়াবিন তেল পাইলাম ১৩ হাজার টাকার মাল কিনে। না হয় মাল দিবে না, কী করুম? এই যে সাড়ে ৬ হাজার টাকার মুদি মাল দিল, আমার চালান তো আইটকা গেল,” বলেন এক দোকানি।

বাজারে বোতলের সয়াবিন তেলের সরবরাহ বাড়লেও সব বোতল দোকানের তাকে রাখছেন না বিক্রেতারা; বলছেন, যারা পরিচিত আর নিয়মিত ক্রেতা, কিংবা তেলের সঙ্গে আরও বেশি জিনিস কিনছেন, তাদেরই কেবল বোতলের তেল দিচ্ছেন।

কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বাজারজাতকারী কোম্পানির প্রতিনিধিরা অন্যান্য জিনিস নেওয়ার শর্তে বোতলের তেল দিচ্ছেন। তেল চাইলে তার সঙ্গে সঙ্গে নুডলস, মশলা বা একই কোম্পানির অন্য পণ্য ধরিয়ে দিচ্ছেন। ফলে অল্প যা তেল পাচ্ছেন, তা ক্রেতা ধরে রাখার জন্য পরিচিতজনদের কাছেই বিক্রি করছেন।

রাজধানীর শনির আখাড়ার আলিফ স্টোরের স্বত্বাধিকারী মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তেল সবার কাছে আছে, কেউ ডিসপ্লে করছে না, করবেও না।”

তার কথা, “রেগুলার কাস্টমারের জন্য তেল। কেউ শুধু সয়াবিন তেল নিতে আসলে কোনো দোকানদারই দিবে না। রেগুলার কাস্টমার তো আমার কাছেই তেল চাইবে। তাই যা আছে, তা তাগোই দিমু।”

‘সরবরাহ সংকটের পরিস্থিতিতে’ বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো বোতলের তেল বিক্রিতে ‘কৌশল নিচ্ছে’ বলে অভিযোগ তার।

“কোম্পানির মসলা না নিলে তেল দেবে না। আরে! মসলা কাস্টমার চাইলে তো বেচুম। ফ্রেশ কোম্পানি তেলের লগে নুডলস বেচতে কয়। নইলে তেল দিবে না। হের নুডলস তো কাস্টমার চায় না। হে চায় আরেক কোম্পানির নুডলস। এহন বাধ্য হইয়া নিতে হয়। কবে এসব মাল বিক্রি শেষ হব কে জানে।”

 

যাত্রাবাড়ীর কাজলার মা-বাবার দোয়া ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের স্বত্বাধিকারী নজরুল ইসলামও বললেন একই কথা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ফ্রেশ কোম্পানির তেল নিতে হলে তার মসলা, না হয় হালিম মিক্সড নিতেই হবে। তার হালিম মিক্স তো সবাই নেয় না। কাস্টমার ধরে রাখতে বাধ্য হয়ে সয়াবিন তেল নিলাম।

“সাড়ে ৬ হাজার টাকার সয়াবিন তেল পাইলাম ১৩ হাজার টাকার মাল কিনে। না হয় মাল দিবে না, কী করুম? এই যে সাড়ে ৬ হাজার টাকার মুদি মাল দিল, আমার চালান তো আইটকা গেল। চলতি মাল (সবসময় বিক্রি হওয়া মুদি পণ্য) দিলে তো সমস্যা আছিল না। কবে বিক্রি হইব কে জানে।”

 

খুচরা দোকানিরা এমন অভিযোগ করলেও বোতলের তেল বাজারজাতকারী কোম্পানি ফ্রেশসহ অন্যরা সেসব অভিযোগ অস্বীকার করছে। মাঠপর্যায়ের বিক্রয় প্রতিনিধিদের (এসআর) দুয়েকজন কোম্পানির পণ্য বিক্রির টার্গেট পূরণে অন্যান্য মুদি মালামাল নেওয়ার শর্তে তেল বিক্রির কথা বললেও বেশিরভাগ এসআর (সিলস রিপ্রেজেন্টেটিভ) ও ডিলারও অভিযোগ অস্বীকার করছেন।

কোম্পানিগুলো বলছে, বাজারে তেলের ‘সংকট নেই’। অন্য পণ্য নেওয়ার শর্তে এসআর ও ডিলারদের তেল বিক্রির কোনো নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি, বরং কঠোরভাবে নিষেধ করা আছে।

দাম বাড়ার ৪ মাসেও সরবরাহ ‘ঠিক হয়নি’

দেশে ভোজ্য তেলের সংকটের শুরু গতবছরের ডিসেম্বরে। সে সময় বাজারে সরবরাহ সংকটে দেখা দিলে এক দফা দাম বাড়ে। গত বছরের ৯ ডিসেম্বর সরকার ৮ টাকা বাড়িয়ে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৭৫ টাকা, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৫৭ টাকা,খোলা পাম তেল ১৫৭ টাকা নির্ধারণ করে। এতেও তখন পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি।

দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজার থেকে বোতলের সয়াবিন তেল উধাও হতে শুরু করে। রোজা শুরুর পরেও পরিস্থিতির তেমন পরিবর্তন না দেখা যায়নি। বেশিরভাগ দোকানিই বোতলের সয়াবিনের সংকটের কথা বলেন, বেশি দামে বিক্রি করেন খোলা তেল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী এবার রোজার মওসুমে সয়াবিন তেলের আমদানি বেড়েছে আগের বছরের চেয়ে ৩৪ শতাংশ বেশি। সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা গত ৩ মার্চ মোহাম্মদপুর টাউন হল কাঁচাবাজার পরিদর্শন শেষে দুই দিনের মধ্যে সয়াবিন তেলের সরবরাহ সংকট স্বাভাবিক হওয়ার কথা বলেন। তবে সেই সংকট ‘এখনও কাটেনি’।

রোজার এক সপ্তাহ পর থেকে দোকানিদের অনেকে অল্প কিছু তেলের বোতল সামনে আনছেন। দ্বিতীয় সপ্তাহে এসেও বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো থেকে কম তেল পাওয়ার কথা বলছেন তারা। আর বিক্রিও করছেন ‘মুখ চিনে’ কিংবা অন্যান্য পণ্য যারা বেশি নিচ্ছেন সেসব ক্রেতাদের কাছে।

কোম্পানির অন্য পণ্য নেওয়ার শর্তে তেল কেনা খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, গ্রাহক রুচি-পছন্দ অনুযায়ী একেক কোম্পানির একেক পণ্য নিয়ে থাকেন। কারও চাল পছন্দ হলেও নুডলস পছন্দ হয় আরেক কোম্পানির। হালিম মিক্স পছন্দ হলে সেই কোম্পানির তৈরি মসলার প্যাকেট নিচ্ছে না। মসলার প্যাকেট কিনছেন আরেক কোম্পানির। এতে বিপাকে পড়ছেন বিক্রেতারা।

‘যে দোকানি মাল নিব, তারে তেল দিই’

কোম্পানির অন্য পণ্য বিক্রির টার্গেট পূরণে শর্ত দিয়ে তেল বিক্রির কথা বলেছেন যাত্রাবাড়ী এলাকার একজন এসআর।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “তেল নিতে হলে কিছু না কিছু অন্য প্রডাক্ট নিতে হবে। তেল যা দেয় তার সঙ্গে আরও ৪০ শতাংশ আদার্স প্রডাক্ট সেল করতে কোম্পানি আমাদের দিয়ে দেয়। তাই আদার্স প্রডাক্ট হালকা কিছু হলেও নিতে হবে। এটা কোম্পানিই দিয়ে দেয়, এটা তো চালাইয়া দিতে হবে।

“স্যাররা যেভাবে নির্দেশ দেয়, তা মানতে হয়। আমাদের তো টার্গেট দিয়া দেয়। একেক সময় একেকটা টার্গেট। কখনও পানি, হালিম মিক্স বা চাইল (চাল)। গত মাসে পানি বিক্রির টার্গেট ছিল। এ মাসে মসলার টার্গেট, সেই টার্গেট তো ফিলাপ করতে হইব। নইলে বেতন কাটবো, তাই যে দোকানি মাল নিবে, তারে তেল দেই।”

যাত্রাবাড়ী এলাকার একজন ডিলার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের কাজ তো মালামাল দোকানে পৌঁছে দেওয়া। কোম্পানির এসআর অর্ডার কাটবে, আমরা গিয়ে পৌঁছে দেব। যে মাল চাইবে, তাই দিয়া দেই। এসআর তো সরাসরি কোম্পানি ডিল করে।

“কোম্পানি তো এখন টাকা পাঠালে দেখা যায় সব টাকার তেল দেয় না। তেলের লগে আরও মালামাল দিয়ে মোট হিসাব ঠিক করে।”

ঢাকার কারওয়ান বাজারের একটি দোকানের সামনে রাখা হয়েছে সয়াবিন তেলের কয়েকটি বোতল।

ঢাকার কারওয়ান বাজারের একটি দোকানের সামনে রাখা হয়েছে সয়াবিন তেলের কয়েকটি বোতল। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের আলী স্টোরের আলী হোসেন বলেন, “পোলাওর চাল নিলে এসআর তেলের স্লিপ কাটবে, নইলে কাটবে না।”

কারওয়ান বাজারের বিভিন্ন দোকানে ৫ লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল দেখা গেলেও এক বা দুই লিটারের বোতল বেশি দেখা যায়নি বেশিরভাগ দোকানে। মেসার্স রতন ট্রেডার্সেও সাজানো ছিল ৫ লিটারের বোতল। তবে বিক্রয়কর্মী আশিকুর রহমান বললেন, এক-দুই লিটারের বোতলের তেলও দিতে পারবেন।

দোকানে দেখা যাচ্ছে না কেন, এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “জায়গা তো কম। তাই সামনে রাখি নাই। লাগলে বলেন, বের করে দেব।”

সরবরাহ সংকটের পরিস্থিতিতে বোতলের তেলে লাভের হিসাব মেলাতে না পেরে বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন মতিঝিলের ‘বি বাড়িয়া ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের’ মালিক আয়নাল হোসেন। তিনি বলেন, “কোম্পানি রেট দেয় এক লিটার ১৭৫ টাকা। এহন গায়ের রেট (সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য) তো লেখা থাকে ১৭৫ টাকাই। আমি তো কাস্টমারের গাইল খাই এক-দুই টাকা বাড়তি চাইলে। তাই তেল বিক্রি বন্ধ।

প্রতিযোগিতা কমিশন কী বলে

প্রতিযোগিতা আইন ২০১২ অনুযায়ী নির্দিষ্ট কোনো পণ্য কেনার ক্ষেত্রে অন্য পণ্য কিনতে ভোক্তাকে বাধ্য করা যাবে না। উৎপাদক থেকে শুরু করে বিক্রেতা পর্যন্ত এই আইনের লঙ্ঘন হলে শাস্তি পেতে পারেন।

তেল বিক্রির ক্ষেত্রে অন্য পণ্য ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনও। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছেন কমিশনের চেয়ারপারসন এ এইচ এম আহসান।

বাজারের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে প্রতিনিধি দল পাঠানোর কথা তুলে ধরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ভোক্তা স্বাধীনভাবে পণ্য কিনতে পারবেন। তাকে কোনো প্যাকেজ বা বান্ডেল ধরে পণ্য কিনতে বলতে পারেন না উৎপাদক বা বিক্রেতা।

“আমরা বিষয়টি শুনেছি, তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা মাঠে কাজ শুরু করেছেন। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তা সত্যি হলে আমরা স্বপ্রণোদিত হয়ে পদক্ষেপ নেব।”

উৎপাদক বা কোম্পানি পর্যায়ে তদন্ত দলটি কাজ করবে বলে জানান তিনি।

‘জোর-জবরদস্তি করি না’

পুষ্টি সয়াবিন তেল বাজারজাত করে টিকে গ্রুপ। কারওয়ান বাজারে এই কোম্পানির এসআর কামাল আহমেদ দাবি করেন, তেল বিক্রিতে কোম্পানির অন্য মালামাল নিতে তারা বাধ্য করেন না।

“আমরা তো সব মাল বিক্রি করি। রিকোয়েস্ট করি তেলের সঙ্গে অন্য মাল নিতে। সে (দোকানি) তো সব প্রডাক্ট বিক্রি করবে। কাস্টমারকে তো কোনো না কোনো কোম্পানির মাল দেবে। আমাদেরটাও দিলে তো কাস্টমার নেবে। তাই রিকোয়েস্ট করি।

“কোনো জোর-জবরদস্তি করি না। কেউ কইলে মিছা কথা কইছে। খালি তেল চাইলে, তাও নিতে পারব। তেলের লগে আরও কিছু নেবে কিনা, তার (দোকানির) ইচ্ছা।”

এ বাজারে টিকে গ্রুপের ডিলার সিদ্দিক এন্টারপ্রাইজের সিদ্দিকুর রহমান বলেন, “আমার দোকানে দেখবেন কাগজে লেইখা ওয়ালে সাঁটায়ে দিছি, তেলের সঙ্গে অন্য পণ্য নিতে বাধ্য করা যাবে না। যার ইচ্ছে তেল নেবে, ইচ্ছে হলে অন্য মালও নেবে। কেউ চাপায়ে দিচ্ছে না।

“তেল যেমন পাইতাছি, বাজারে সাপ্লাই দিতাছি। এহন তো আগের চেয়ে মাল বেশি আসছে। যে যার মত নিতে পারবে।”

তীর ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল বাজারজাত করে সিটি গ্রুপ। কারওয়ান বাজারে এই কোম্পানির এসআর গিয়াস উদ্দিন বলেন, “প্রতিদিনই তো মাল দিই। এক কার্টন করে দিই দোকানদারদের। অল্প অল্প (তেল) আসে, অল্প অল্প দিই। একদিন গ্যাপে গ্যাপে এক এক দোকানদারকে মাল (তেল) দিই।”

এসআর গিয়াসের আওতায় ৬০টির মত দোকান আছে। এর মধ্যে প্রতিদিন ৩০-৪০টি দোকানকে সয়াবিন তেলের বোতল দিতে পারছেন বলে জানান তিনি। অন্য পণ্য কেনার শর্তের বিষয়ে তিনি বলেন, “না, কেউ বলতে পারবে না। তেল নিলে শুধু তেলই বিক্রি করি।”

কারওয়ান বাজারের সিটি গ্রুপের ডিলার এ টি ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক সেলিম হোসেন বলেন, “আমার কাছে তেল নিলে অন্য কোনো প্রডাক্ট নিতে হবে না। কার লাগবে বলেন, নিতে পারবে। তেল এখনও এক গাড়ি আছে, নামায়া রাখছি। বাজারে মাল শর্ট হলে তো পইড়া থাকত না।”

কোম্পানির অন্য পণ্য বিক্রির শর্তে বোতলের সয়াবিন বিক্রির অভিযোগের বিষয়ে ফ্রেশ গ্রুপের জ্যেষ্ঠ সহকারী ব্যবস্থাপক তাসলিম শাহরিয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোম্পানির কাজ হল মাল বেচা, আমরা বিক্রি করছি। কোনো টার্গেট দিয়ে দেওয়া হয়নি।

“এসআর যদি সয়াবিন তেলের সঙ্গে আরও কিছু বিক্রি করে এটা তার বিষয়, কোম্পানি দায়ী না। খালি তেলও নিতে পারবে দোকনদার।”

ভোজ্যতেল আমদানিকারক ও বিপণনকারী সিটি গ্রুপের পরিচালক (রেগুলেটরি অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আর্জেন্টিনায় বড় টাইডের (অতি জোয়ার) কারণে জাহাজ সময় মত আসতে পারেনি। তাই সংকট ছিল। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি তেল আসছে, খালাস হইছে একদিন পরেই। তারপর কোম্পানি হয়ে বাজারে যাচ্ছে। শুধু আমাদের না, সবারই একই অবস্থা।”

বাজারে এখন তেলের সংকট নেই দাবি করে তিনি বলেন, “অন্য প্রডাক্ট নিতে হবে এমন শর্ত আমরা কোথাও বলিনি। এসআর করবে তাও না। কঠোরভাবে নিষেধ করা আছে। আমরা ভোক্তা অধিদপ্তরেও লিখিত দিয়ে আসছি।

“তেলের সঙ্গে অন্য কোনো প্রডাক্ট বা প্যাকেজ ধরে বিক্রি করা হবে না। এখন দোকানদার যদি তার কাস্টমারদের বাধ্য করে (তেলের সঙ্গে অন্য জিনিস নিতে) আমরা কী করব বলেন।”