Image description

গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। দায়িত্ব নেওয়ার পরই বিভিন্ন দূতাবাসে ও হাইকমিশনে থাকা রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের নিয়োগ বাতিল এবং রদবদলের উদ্যোগ নেয় নতুন সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর অংশ হিসেবে গত বছরের আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে তলবের প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও অনেক কূটনীতিক এখনো দেশে ফেরেননি, যাদের অনেকে আবার বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রদূত-উপরাষ্ট্রদূত, কাউন্সেলর ও সচিব পদে নিযুক্ত প্রায় ২২ কূটনীতিককে নিজ নিজ মিশন থেকে ঢাকায় সদর দপ্তরে ফিরতে বলা হয়। অনেক কূটনীতিককে অবস্থানরত মিশন থেকে বদলি করে অন্য দেশে যোগদানের নোটিশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত অন্তত ১৪ কূটনীতিকের সঙ্গে চুক্তি বাাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার।

গত বছরের ১৪ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান, জার্মানি, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতদের চুক্তি বাতিল করে সরকার। একই সময় মালদ্বীপে প্রেষণে নিযুক্ত হাইকমিশনারকেও দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিমকে ঢাকায় ফিরে আসতে বলা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১ অক্টোবর ভারত, নিউইয়র্কে স্থায়ী মিশন, বেলজিয়াম, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগালে দায়িত্ব পালনরত পাঁচ রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারকেও ঢাকায় ফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে নির্দেশনা মেনে এখনো অনেকেই দেশে ফেরেননি। তলবেও কেন ফিরছেন না কূটনীতিকরা: সৌদি আরবে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পাওয়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী দেশে ফেরার নির্দেশ দেওয়ার পর তিনি দেশে না ফিরে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন বলে জানা গেছে। একইভাবে, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিমও সরকারের নির্দেশনা মেনে দেশে ফেরেননি।

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত সাংবাদিক মিথিলা ফারজানা দেশে না ফিরে রাজনৈতিক আশ্রয়ে অবস্থান করছেন কানাডায়। এ ছাড়া কলকাতা ডেপুটি মিশনের প্রথম সচিব আমিনুল পলাশও দেশে না ফিরে যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন। এই ইস্যুতে সর্বশেষ আলোচনায় মরক্কোয় নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ হারুন আল রশিদ। দেশে ফেরার নির্দেশ দেওয়ার পর তা না মেনে তিনি চলে গেছেন কানাডায়। সেখানে থেকে সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে তিনি ফেসবুকে পোস্ট দিলে বিষয়টি আলোচনায় আসে। এর প্রতিক্রিয়া তার কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু সরকারের নির্দেশ মেনে কেন দেশে ফিরছেন না কূটনীতিকরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে জানান, যাদের চুক্তি বাতিল করা হয়েছে, তাদের অনেকেই দেশে ফেরেননি। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত এবং পররাষ্ট্র ক্যাডারের বাইরের কর্মকর্তা। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্তদের চুক্তি বাতিল হওয়ায় তাদের দেশে ফেরা-না ফেরার কিছু যায় আসে না।

 এদিকে ঢাকায় ফেরার নোটিশ পাওয়া মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের দূতাবাসের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের বিধান না থাকায় বর্তমান সরকারের কোনো আদেশ তারা মানতে রাজি নন। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে কাজ চালিয়ে নিতে দেশে আমরা যাব না। দেশে গেলেই আমাদের নানাভাবে হয়রানি করা হবে। এ ছাড়া দেশে ফিরলে জীবনের ঝুঁকি রয়েছে, তাই দেশে ফিরে যাব না।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কী ভাবছে: সরকারের নির্দেশ অমান্য করে দেশে না ফেরা কর্মকর্তাদের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কী ভাবছে—জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, যারা আগের সরকারের আমলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছে তাদের সঙ্গে এরই মধ্যে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। ফলে তাদের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের আর কোনো সম্পর্ক নেই। তাই তাদের দেশে ফিরে আসা বা না আসায় কিছুই যায়-আসে না। তবে ফরেন ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তা যদি মন্ত্রণালয়ের আদেশ না মানে তাহলে তাদের নিয়ে ভাববে মন্ত্রণালয়। বিদেশি দূতাবাস, হাইকমিশন ও মিশনে কর্মরত ফরেন ক্যাডারদের মধ্যে যাদের দেশে ফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাদের সবাই দেশে ফিরেছেন কি না জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, প্রায় সবাই দেশে ফিরেছেন এবং দেশে এসে দায়িত্বভারও গ্রহণ করেছেন। নির্দেশনা মেনে যারা দেশে ফিরবেন না তাদের বিষয়ে সরকার কোনো পদক্ষেপ সরকার নেবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেখুন কেউ না এলে কীভাবে তাকে জোর করে আনা সম্ভব! তবে সরকার তাদের নিয়ে কোনো কিছু সেভাবে ভাবছে না, যদি না তারা মরক্কোর রাষ্ট্রদূতের মতো দেশ ও সরকারপ্রধান নিয়ে কটূক্তি বা ষড়যন্ত্র করে।

যারা পালিয়ে গেছেন, তারা বাজে মন্তব্য বা বানোয়াট ও অস্থিতিশীল কিছু না করলে কিছুই করার প্ল্যান নেই।’ নির্দেশ অমান্যকারীদের পাসপোর্ট বাতিল: কূটনীতিকদের মধ্যে যারা সরকারের নির্দেশ মেনে দেশে ফিরছেন না, তাদের অনেকেই বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন কানাডায় অবস্থানরত সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ হারুন আল রশিদ, যিনি সম্প্রতি ফেসবুকে অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে পোস্ট করেছেন। তিনি নিজেকে ‘নির্যাতিত কূটনীতিক’ ও ‘নির্বাসিত ঔপন্যাসিক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে তার পাসপোর্ট বাতিল করেছে এবং তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, একইভাবে রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের কনসুলার রাকিব উল্লাহ ও তার পরিবারের সদস্যদের কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে। জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূত সাহাবুদ্দিন ও তার পরিবারের সদস্যদেরও কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে। তারা সপরিবারে বিদেশে রয়েছেন এবং দেশে ফিরতে নারাজ। দেশে ফেরা কর্মকর্তাদের অনেকে উচ্চপদে: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা জানান, ক্যাডারদের মধ্যে যারা সরকারের নির্দেশ মেনে ফিরেছেন, তারা এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছেন।

তাদের মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগে পরিচালক কিংবা অন্য পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কয়েকজন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, মহাপরিচালক মোহাম্মদ নূরে আলমকে পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত অনুবিভাগের মহাপরিচালক পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আফ্রিকা অনুবিভাগের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে দেশে ফেরেন এ এফ এম জাহিদ-উল-ইসলাম। পরে তাকে পশ্চিম ইউরোপ ও ইইউ অনুবিভাগের মহাপরিচালক হিসেবে পদায়ন করা হয়। এ ছাড়া মহাপরিচালক বি এম জামাল হোসেনকে আফ্রিকা অনুবিভাগের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সুজন দেবনাথকে বাংলাদেশ দূতাবাস থিম্পু থেকে ঢাকায় এনে মিয়ানমার অনুবিভাগের পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।