
দুই সপ্তাহ পরেই ঈদ। ঈদকে সামনে রেখে ঢাকার অপরাধ জগতে তৎপরতা বেড়েছে। চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী, মাদক ব্যবসায়ী, অজ্ঞানপার্টি, জাল টাকার কারবারি থেকে শুরু করে চোর, ডাকাত, সাইবার অপরাধীরা তৎপর। ঈদ উপলক্ষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে কমবেশি টাকা থাকে। আর এই সুযোগটা কাজে লাগায় অপরাধীরা। এবার ভিন্ন এক অবস্থায় ঈদ আয়োজন হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সরকার। ঈদে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রেখে নির্বিঘ্নে নাগরিকদের ঈদ উদ্যাপনের সুযোগ করে দেয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পেশাদার অপরাধী থেকে শুরু করে মৌসুমী অপরাধীরা তৎপরতা শুরু করেছে। ছিনতাইকারীর ভয়ে মানুষ খুব জরুরি কাজ ছাড়া কেউ গভীর রাতে বাইরে যান না। প্রকাশ্য বেশ কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ভাইরালের পরপরই মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পুলিশের পক্ষ থেকে ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হলেও থেমে থাকেনি ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য। প্রতিরাতেই শহরের বিভিন্ন স্থানে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। রমজান মাসে সেহরি করার পর অনেকেই গভীর ঘুমে মগ্ন থাকেন। বাইরে যানবাহন চলাচল খুব একটা থাকে না। এই সুযোগেই ছিনতাইকারীরা পথচারী বা রিকশা আরোহীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রমজান মাসে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষজন জরুরি কাজে বা ব্যবসার কাজে ঢাকা আসছেন। ট্রেন বা বাস থেকে নামার পর গন্তব্য যাওয়ার পথেই তারা ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন। এসব ঘটনা আমলে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ঈদ ঘিরে নিজেদের পরিকল্পনা সাজাচ্ছে। পুলিশের সঙ্গে অন্যান্য বাহিনীও এবার ঈদে মানুষের নিরাপত্তা দিতে মাঠে থাকবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বেড়েছে চাঁদাবাজি: রমজানে ফুটপাথ থেকে শুরু করে শপিং মল, পাড়া মহল্লার ছোটখাটো ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, পোশাক কারখানা, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকসহ নির্মাণাধীন বাড়ির মালিক, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ও প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা তুলছে চাঁদাবাজরা। ফুটপাথের হকাররা অভিযোগ করেছেন, নিয়মিত সময়ে ঢাকার বিভিন্ন ফুটপাথে যে পরিমাণ হকার ব্যবসা করেন রমজানে কয়েকগুণ বেড়ে যায়। যারা ফুটপাথ থেকে চাঁদা তুলেন তারা চাপাচাপি করে হকারদের বসার স্থান দিচ্ছেন। এককালীন টাকার পাশাপাশি প্রতিদিন তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে চাঁদাবাজরা। এ ছাড়া নিয়মিত ব্যবসায়ীরা অন্য সময় যে চাঁদা দেন রমজানে সেটিও দ্বিগুণ করা হয়েছে। লাইনম্যানখ্যাত চাঁদাবাজরা এসব চাঁদা তুলে। এদের শেল্টার দিচ্ছে এলাকাভিত্তিক অসাধু রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। চাঁদার ভাগ পুলিশের পকেটে যায়। বিটভিত্তিক পুলিশ সদস্যরা ফুটপাথের হকারদের চাঁদার ভাগ পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সূত্রগুলো বলছে, কারাবন্দি অনেক সন্ত্রাসী ও শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিনে মুক্ত হয়েছে। তাদের কেউ কেউ প্রকাশ্য ঘুরে বেড়িয়ে নানা অপরাধ করছে। আবার যারা পলাতক অবস্থায় দেশের বাইরে অবস্থান করছেন তারাও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়েছেন। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, সন্ত্রাসীরা বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজি করছে। কিন্তু যারা ভুক্তভোগী হচ্ছেন তারা থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ করছেন না। কেউ যদি অভিযোগ না করে তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারবে না। সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করলে চাঁদাবাজরা যতই শক্তিশালী হোক না কেন তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
জাল নোটের কারবারিরা তৎপর: রমজানে জাল নোটের কারবারিরা বেপরোয়া। প্রতিবছর ঈদের বাজারে চক্রগুলো কোটি কোটি টাকার জাল নোট ছড়িয়ে দেয়। এরকম একটি চক্রকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। কামরাঙ্গীরচর ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে ২০ লাখ টাকার জাল নোট, নোট তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে ডিএমপি’র কামরাঙ্গীরচর থানা পুলিশ। এ সময় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে তারা বিভিন্ন ধরনের জাল নোট তৈরি করে রাজধানীসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রয় করতো। ঈদকে সামনে রেখে বিপুল পরিমাণ জাল নোট তৈরি করে সেগুলো সরবরাহ করার জন্য তাদের হেফাজতে রেখেছিল। এই চক্র ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি চক্র প্রতিবছর ঈদবাজারে জাল নোট ছড়িয়ে দিতো। গোয়েন্দা পুলিশের কাছে বেশ কয়েকবার তারা গ্রেপ্তার হয়েছে। এ ছাড়া র্যাবও অনেক জাল নোটের কারবারিকে গ্রেপ্তার করেছে। আগে গ্রেপ্তার হওয়া অনেক আসামি এখন জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের একই কারবারে জড়িয়েছে। কারণ ঈদবাজারে টাকার ছড়াছড়ির মধ্যে জাল নোট ঢুকিয়ে তারা দেদারছে ব্যবসা করে।
অপরাধে অস্ত্রের ব্যবহার: অপরাধীদের অনেকেই এখন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অস্ত্র ব্যবহার করছে। আগে থেকেই অপরাধীদের হাতে অবৈধ অস্ত্রের মজুত ছিল। ৫ই আগস্টের পর থানা থেকে সরকারি অস্ত্র লুট হলেও সেগুলো এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এখনো বহু অস্ত্র ও গোলাবারুদ হাত বদল হয়ে সন্ত্রাসীদের কাছে রয়েছে। আর সন্ত্রাসীরা সুযোগ বুঝে এগুলো বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করছে। অস্ত্র দেখিয়ে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুনখারাবিসহ বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। পুলিশ, ডিবি, র্যাব, যৌথ বাহিনী ও সেনাবাহিনীর অভিযানে প্রায়ই অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার হচ্ছে। গত ১১ ও ১২ই মার্চ কামরাঙ্গীরচরে যৌথ অভিযানে ৩০ রাউন্ড পিস্তলের গুলি, চারটি ককটেল ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধারসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একইদিন রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর এলাকা থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ২০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছে ডিএমপি’র উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ।
মলমপার্টির দৌরাত্ম্য: কেনাকাটার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন শপিং মল, পাইকারি মার্কেটে আনাগোনা করা ব্যবসায়ী ও সাধারণ ক্রেতাদের টার্গেট করে মলমপার্টি ও অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে। বিভিন্ন কৌশলে খাবারের সঙ্গে অথবা কিছু নাকে স্পর্শ করে মানুষকে অজ্ঞান করে সবকিছু লুটে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু লুটে নিচ্ছে তা নয় যাদের ওপর এসব চক্রের সদস্য কেমিক্যাল ব্যবহার করছে তাদের অনেকেরই মৃত্যু হচ্ছে। অনেকেই জীবন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। রমজান মাস শুরু হওয়ার পর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে রাতদিন অজ্ঞানপার্টির কবলে পড়ে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়া রোগীরা আসছেন। এ ছাড়া রমজান ও ঈদকে ঘিরে যারা ঢাকায় প্রবেশ করছেন তাদের টার্গেট হিসাবে নিয়ে চক্রগুলো হাতিয়ে নিচ্ছে সব।
নাগালের বাইরে মাদক কারবারিরা: অন্যান্য অপরাধীদের মতো মাদক কারবারিরা দেদারছে মাদকের কারবার করে যাচ্ছে। পুরাতন কারবারিদের সঙ্গে এখন নতুন কারবারিরা যুক্ত হয়েছেন। অনলাইন ও অফলাইন উভয় মাধ্যমে চলে কারবার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের তোয়াক্কা না করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। দেশের বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পাইকারি মাদক এনে তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা দেশে। ঢাকার অলিগলি থেকে শুরু করে ছোট বড় সব মাদকের স্পটে এখন অনেকটা প্রকাশ্য কারবার হয়। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে সড়কপথ, আকাশপথ, রেলপথ ও জলপথে ছড়িয়ে দেয়া হয় পুরো দেশে। ঈদকে ঘিরে কারবারিরা ব্যাপকভাবে মাদকের মজুত করছেন। কারণ ঈদের আগে পরে মাদকের চাহিদা বেড়ে যায় অনেক। মাদক নিয়ন্ত্রণে আলাদা অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট কাজ করার পরেও নির্মূল করা যাচ্ছে না। শুধু লোক দেখানো কিছু অভিযান দিয়ে মাদক নির্মূলের চেষ্টা করা হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, ঈদকেন্দ্রিক আমরা সকল মার্কেটে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছি। অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টি, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজসহ অন্যান্য অপরাধীদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। অভিযোগ আসলেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ। তিনি বলেন, মানুষের ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে ডিএমপি নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করছে। মানুষ নির্বিঘ্নে বাড়ি যেতে পারবে।