
মসজিদে বসে নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত, জিকির ও নামাজ পড়তে ভুলতেন না তিনি। এতে অনেকের কাছে তিনি ছিলেন ধার্মিক ওসি। শুধু তাই নয়, রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষকে নিজ অর্থে চিকিৎসা দিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে থাকার ব্যবস্থা করে মানবিক ওসি হিসাবেও প্রশংসা পেয়েছেন।
বলছিলাম ময়মনসিংহের নান্দাইল মডেল থানায় অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসাবে মাত্র ১৬৯ দিন দায়িত্ব পালন করা ফরিদ আহমেদের কথা। এই অল্প দিনেই বেশ আলোচনা-সমালোচনার পাত্র হয়েছেন তিনি। তিনবার জেলার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছেন। মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে জিরো-টলারেন্স, গরিবদের দান-সদকা এবং মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় ও কুরআন তেলাওয়াত করে স্থানীয়দেরও প্রশংসা কুড়িয়েছেন। কিন্তু এসবই ছিল তার ছদ্মবেশ! তলে তলে নানা অপকর্ম করেছেন এই ওসি, যা ফাঁস হয় বৃহস্পতিবার তাকে বদলির পর।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ওসি ফরিদ নান্দাইলে যোগ দেন। ৫ দিন পর ১ অক্টোবর উপজেলায় কর্মরত সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি। সেখানে জুয়া ও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেন। এরপর জুয়াড়ি ও মাদক কারবারিদের ধরে জেলহাজতে পাঠান। পাশাপাশি মসজিদে বসে নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত, জিকির ও নামাজ পড়তে ভুলতেন না। এতে অনেকের কাছে তিনি ছিলেন ধার্মিক ওসি। শুধু তাই নয়, রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষকে নিজ অর্থে চিকিৎসা দিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে থাকার ব্যবস্থা করে মানবিক ওসি হিসাবেও প্রশংসা পেয়েছেন।
তবে এই ছদ্মবেশের আড়ালে বিভিন্ন অপকর্ম করে বেড়ান ওসি ফরিদ। মাদক কারবারিদের ধরে ৫৩/৫৪ ধারায় চালান করে নিতেন মোটা অঙ্কের বকশিশ। এতে পরদিনই ওইসব আসামি ছাড়া পেয়ে যেত। তেমনি ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলাকারীদের ধরেও মামলা বাণিজ্য করেন। বিভিন্ন হাটবাজারে সরকারি খাস জায়গায় গড়ে ওঠা দোকান, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা নিতেন তিনি। বাজারসংলগ্ন সড়ক ও জনপথের জায়গায় অস্থায়ী ব্যবসায়ীদের ধরে এনে জেলহাজতে পাঠাতেন। আবার নিয়মিত সাপ্তাহিক ও মাসিক চাঁদার বিনিময়ে সেই জায়গায় ব্যবসার সুযোগ করে দিতেন। এছাড়া কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বাকিতে মালামাল নিয়ে টাকা দেননি তিনি।
এছাড়াও নান্দাইল চৌরাস্তা বাজারের ব্যবসায়ী রুবেল, কাজল মিয়াসহ আরও কয়েকজনকে ধরে এনে জেলহাজতে পাঠানোর হুমকি দেন তিনি। পরে মাসিক ২ হাজার-৫ হাজার টাকা চাঁদা দেওয়ায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। প্রতি মাসেই লোক পাঠিয়ে ওসি টাকা নিতেন।
এরই মধ্যে গত বছরের ২৪ নভেম্বর ওসি ফরিদ মাদক উদ্ধারে জেলার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পান। এরপর ২ ফেব্রুয়ারি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ অন্যান্য বিষয়ে জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি নির্বাচিত হন তিনি। এর ১১ দিন পর ১৩ ফেব্রুয়ারি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার ও মামলার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য তিনি আবারো জেলার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জন করেন। ফলে তার এসব ‘গৌরব’র আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় সব অপকর্ম।
কিন্তু বৃহস্পতিবার অজ্ঞাত কারণে তাকে ময়মনসিংহ পুলিশ অফিসে বদলি করা হয়। ফলে শুক্রবার ভোর রাতেই তড়িঘড়ি করে ময়মনসিংহ পুলিশ অফিসে যোগ দেন তিনি। ওসির বদলির খবরে পাওনাদাররা থানায় এসে ওসিকে খুঁজতে থাকেন এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর শুক্রবার রাতে থানায় এসে দুজন পাওনাদারে টাকা পরিশোধ করেন ওসি।
নান্দাইল বাজার প্রাইম কালেকশনের মালিক মোফাজ্জল হোসেন খান রেণু বলেন, ওসি ফরিদ আমার কাছ থেকে ফ্রিজ, ফার্নিচারসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী নিয়েছিলেন। শুক্রবার বকেয়া ১ লাখ ৪ হাজার ২৫০ টাকা পরিশোধ করেন তিনি।
সূবর্ণ ইলেকট্রনিক্সের মালিক ব্যবসায়ী ফরহাদ মিয়া জানান, ওসির কাছ থেকে তিনিও বকেয়া ১১ হাজার টাকা ফেরত পেয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি ফরিদ আহমেদ সব অভিযোগ অস্বীকার করে যুগান্তরকে বলেন, এগুলো আমার নামে গুজব রটানো হচ্ছে। তবে পাওনাদারের টাকা পরিশোধ করে দিয়েছি। এখানে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল।