
বাংলাদেশ সীমান্তে ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১৫১ জন বাংলাদেশী। তাদের মধ্যে কমপক্ষে ১১৮ জনই গুলিতে নিহত হয়েছেন।
বাংলাদেশ সীমান্তে ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১৫১ জন বাংলাদেশী। তাদের মধ্যে কমপক্ষে ১১৮ জনই গুলিতে নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে একজন মিয়ানমার সীমান্তে গুলিতে নিহত হয়েছেন। বাকি ১১৭ জন নিহত হয়েছেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে। গত পাঁচ বছরের সীমান্ত হত্যাকাণ্ড পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিভাগ হিসেবে রংপুরেই সবচেয়ে বেশি সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ওই সময়ে সীমান্তে প্রাণ হারানো ১১৮ জনের মধ্যে ৬১ জনই রংপুর বিভাগের। অর্থাৎ মোট নিহতের ৪০ শতাংশই এ বিভাগের। আর জেলা হিসেবে নিহতের ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি লালমনিরহাটে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশের সীমান্তে হত্যার শিকার হয়েছেন ৩০ বাংলাদেশী। এর মধ্যে ২৫ জনেরই মৃত্যু হয়েছে প্রতিবেশী দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে। নিহত ৩০ জনের মধ্যে ১১ জনই রংপুর বিভাগের। ২০২৩ সালে সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৩১ জন। এর মধ্যে ১৪ জনই রংপুর বিভাগের বাসিন্দা। ২০২২ সালে নিহত হয়েছিলেন ২৩ জন। এর মধ্যে ১০ জনই রংপুর বিভাগের। ২০২১ সালে সারা দেশে নিহত ১৮ জনের মধ্যে রংপুর বিভাগের আটজন। ২০২০ সালে সীমান্তে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কভিডের ওই বছর মারা গেছেন ৪৯ জন। এর মধ্যে ১৮ জনই ছিলেন রংপুর বিভাগের। একই বছর রাজশাহী বিভাগে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ১৪ জন।
জেলা হিসেবে গত পাঁচ বছরে লালমনিরহাট জেলায় সর্বোচ্চ ১৯ জন বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছেন। বিজিবির তথ্য বলছে, লালমনিরহাটে ২০২০ সালে পাঁচজন, ২০২১ ও ২০২২ সালে চারজন করে এবং ২০২৩ ও ২০২৪ সালে তিনজন করে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। লালমনিরহাটের পরে রয়েছে ঠাকুরগাঁও। উত্তরের এ জেলায় ২০২৪ সালে দুজন প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানিয়েছে বিজিবি। যদিও গণমাধ্যমে ওই বছর তিনজন নিহতের খবর উঠে এসেছে। এছাড়া ২০২৩ সালে চারজন মারা গেছেন। ২০২১ ও ২০২২ সালে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা না ঘটলেও ঠাকুরগাঁওয়ে ২০২০ সালে পাঁচজন, ২০১৯ সালে ছয়জন ও ২০১৮ সালে তিনজন সীমান্তে হত্যার শিকার হয়েছেন।
এছাড়া পঞ্চগড় জেলায় ২০২৩ ও ২০২৪ সালে আটজন মারা গেছেন। রংপুর বিভাগের আরেক জেলা কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার সীমান্তে ২০২২ ও ২০২৩ সালে একজন করে হত্যার শিকার হয়েছেন। তবে গত বছর জেলার সীমান্তে প্রাণহানি হয়নি।
দিনাজপুর জেলার সীমান্তে শেষ কয়েক বছরে কতজনের প্রাণহানি হয়েছে সে সম্পর্কে বিজিবি-৪২ ব্যাটালিয়ন তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। তারা জানিয়েছে, বিজিবি সদর দপ্তর এ বিষয়ে তথ্য দিতে পারবে। তবে দিনাজপুরের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেলাটির সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে আটজন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। এছাড়া সীমান্ত থেকে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ২০২৩ সালে জেলাটির সীমান্তে দুজন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেলেও ২০২৪ সালের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
লালমনিরহাট বিজিবি-১৫ ব্যাটালিয়নের সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাকিল আলম বলেন, ‘আমি তিন মাস আগে এখানে বদলি হয়ে এসেছি। এ সময়ে কোনো হত্যার ঘটনা ঘটেনি।’
আগের ঘটনার বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে অপরাগতা প্রকাশ করেন।
রংপুর বিজিবির সেক্টর কমান্ডার কর্নেল সাব্বির আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সীমান্ত এলাকাগুলোয় কর্মসংস্থানের সুযোগ কম থাকায় অনেকে ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে পণ্য আনতে যায়। আমরা মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি।’
আসকের তথ্য বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৬১১ জনের মতো। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্যমতে, শেষ ১০ বছরে (২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল) সীমান্তে হত্যার শিকার হয়েছেন ৩০৫ জন বাংলাদেশী। এইচআরএসএসের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে ২৬, ২০২৩ সালে ৩০, ২০২২ সালে ২৩, ২০২১ সালে ১৭ ও ২০২০ সালে ৫১, ২০১৯ সালে ৪২, ২০১৮ সালে ১৫, ২০১৭ সালে ৩০, ২০১৬ সালে ২৮ ও ২০১৫ সালে সীমান্তে নিহত হয়েছেন ৪৩ জন।
বিষয়টি নিয়ে গুম সংস্কার কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘আমার কাছে মনে হচ্ছে, হত্যার জবাব যেভাবে দেয়া দরকার সেভাবে দিতে পারছি না। আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে কোথাও হয়তো দুর্বলতা রয়েছে। সেজন্য ভারত নিজেদের “বিগ ব্রাদার” ভাবছে। সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি পাত্তা দিচ্ছে না।’
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের দ্বারস্থ হওয়ার পরামর্শ দিয়ে এ মানবাধিকার কর্মী আরো বলেন, ‘সীমান্তে হত্যা বন্ধে আন্তর্জাতিক মহলের দ্বারস্থ হতে হবে। বিশেষ করে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হওয়া দরকার। না হয় সমুচিত জবাব দেয়া দরকার।’
এদিকে সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে ভারতের নয়াদিল্লিতে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৫তম সীমান্ত সম্মেলন শেষ হয় গত ২০ ফেব্রুয়ারি। বিজিবি-বিএসএফের মহাপরিচালকরা এতে অংশ নেন। সম্মেলনে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে বিএসএফ মহাপরিচালকের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবির পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল এসএম শফিকুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সীমান্ত হত্যা বন্ধে বিএসএফের সঙ্গে ডিজি পর্যায়ের বৈঠকে শক্ত প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। ব্যাটালিয়ন, সেক্টর ও অঞ্চলিক কমান্ডার পর্যায়ে সমন্বয় কার্যক্রম সক্রিয়ভাবে পরিচালিত হচ্ছে। পাশাপাশি নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরার জন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে। সীমান্তবর্তী জনগণের মধ্যে চোরাচালানের প্রবণতা কমাতে স্থানীয় সচেতনতা কার্যক্রম এবং পুনর্বাসন কর্মসূচি বাড়ানো হয়েছে। সীমান্তে কোনো ধরনের অপরাধমূলক বা অবৈধ চোরাচালান কার্যক্রমের ক্ষেত্রে বিএসএফ যেন প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করে সে ব্যাপারে কঠোর বার্তা পাঠানো হয়েছে।