Image description
শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক হিসেবে ১৯৯৫ সালে যাত্রা শুরু করা আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক গ্রাহকবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণ করায় অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর চট্টগ্রামভিত্তিক বিতর্কিত এস আলম শিল্প গ্রুপ ও অন্য এক ব্যবসায়ী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার পর ব্যাংকটির শীর্ষ কর্মকর্তারা নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন বলে অভিযোগ ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ব্যাংকটির পর্ষদ পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের অভিযোগ, আগের পর্ষদের নিয়োগ দেওয়া বিতর্কিত কর্মকর্তারা এখনো বহাল আছেন। নতুন পর্ষদের চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন পরিচালককে চট্টগ্রামভিত্তিক একটি গার্মেন্টস ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রণ করেন অভিযোগ করে তারা বলছেন, এজন্য ব্যাংক পর্ষদের সিদ্ধান্ত আসে চট্টগ্রাম থেকে। কালবেলার অনুসন্ধানেও বিষয়গুলোর সত্যতা পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান পর্ষদের প্রতিনিধি গত ৩ মাসে বেশ কয়েকবার চট্টগ্রামভিত্তিক একটি গার্মেন্টস ব্যবসায়ী গ্রুপের ডাকে ওই প্রতিষ্ঠানের চট্টগ্রামস্থ অফিসে গেছেন, যিনি এই গ্রুপ থেকে বিলুপ্ত বোর্ডের পরিচালক ছিলেন। এমনকি গ্রুপটির সঙ্গে সাইফুল আলম মাসুদের আত্মীয়তার সম্পর্কও রয়েছে বলেও জানা গেছে। নতুন পরিচালনার পর্ষদ প্রতিটি বোর্ড সভার আগেই চট্টগ্রামভিত্তিক ওই গ্রুপের অফিসে বৈঠক করছে। এক কথায়, চট্টগ্রাম থেকে যে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়, ওই সিদ্ধান্তের ওপরই বোর্ড সভায় নীতি প্রণয়ন করা হচ্ছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, বর্তমান পর্ষদ চেয়ারম্যান এবং অন্য দুজন স্বতন্ত্র পরিচালককে এস আলম ও অন্য একটি গ্রুপ শেয়ার দিয়ে পরবর্তী সময়ে পরিচালক বানানোর প্রলোভন দেখিয়েছে। এজন্য তারা ওই দুটি গ্রুপের স্বার্থ রক্ষার্থে তাদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে চলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সর্বোচ্চ মহলের মদদে এস আলম ও চট্টগ্রামভিত্তিক একটি গার্মেন্টস গ্রুপ ২০০৯ সালে ব্যাংকটি পুরোপরি তাদের দখলে নেয়। চট্টগ্রামের বাইরের অন্তত ৯ জন উদ্যোক্তা পরিচালককে তারা ব্যাংকটি ছাড়তে বাধ্য করে। অন্যদিকে উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার আব্দুল হাদী ও মো. এজাহার মিয়ার সমুদয় শেয়ার জালিয়াতির মাধ্যমে দখল করেন। তারা নানা অপকৌশল ও দুর্নীতির মাধ্যমে এস আলম গ্রুপ ও ওই গ্রুপ ব্যাংকের মোট শেয়ারের অন্তত ৩৭.২৫ (২৩.৭৫+১৩.৫০) শতাংশ শেয়ার কুক্ষিগত করেন। তথ্য বলছে, বর্তমান বোর্ড চেয়ারম্যান খাজা শাহরিয়ারের পিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কাজী শাহেদ জামিল। তিনি চট্টগ্রামভিত্তিক ওই গার্মেন্টস ব্যবসায়ী গ্রুপের কর্মী ছিলেন। তাকে পাঁচ ধাপ ডিঙ্গিয়ে পদোন্নতি দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি এখনো তার স্বপদে বহাল রয়েছেন। শুধু তিনিই নন, আগের বোর্ডের নিয়োগ করা মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান আমীর হোসেন ও কোম্পানি সচিব মনিরুজ্জামানকেও স্বপদে বহাল রেখেছে বর্তমান বোর্ড। তাদের মাধ্যমেই এস আলমের ভাই আব্দুস সামাদ লাবু ও অন্য একজন পরিচালকের কাছে ব্যাংকের সব তথ্য চলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তার দাবি, কাজী শাহেদ, আমীর হোসেন ও মনিরুজ্জামানের মাধ্যমেই ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন আগের পর্ষদের পরিচালকরা। আর নতুন পর্ষদে এস আলমসহ আগের পর্ষদের প্রভাব থাকার কারণে এদের স্বপদে বহাল রাখা হয়েছে। তথ্য বলছে, সাবেক দুই চেয়ারম্যানের নিয়োগ দেওয়া দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। এমনকি যাদের বিরুদ্ধে বিএফআইইউর তদন্তে নানা ধরনের অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ব্যাংকের বর্তমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সিএফও দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎকৃত ৫৪ লাখ টাকা ব্যাংককে ফেরত দিয়েছেন। তারা দীর্ঘদিন ধরে এস আলম গ্রুপ ও চট্টগ্রামভিত্তিক গার্মেন্টস ব্যবসায়ী গ্রুপের দুর্নীতির একান্ত দোসর হিসেবে কাজ করে গেছেন। তাদের বিভিন্ন দুর্নীতির প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বর্তমান পর্ষদ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সূত্র বলছে, স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে নতুন পর্ষদ ব্যাংকে অপ্রয়োজনীয় এডিশনাল এমডি, ইভিপি, এসভিপি, ভিপি ও এভিপিসহ বিভিন্ন পদে অস্বাভাবিকভাবে অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট দিয়ে নিয়োগ বাণিজ্য শুরু করেছেন। অবসরজনিত শূন্যপদে ব্যাংকের নিজস্ব কর্মকর্তাকে নিয়োগ না দিয়ে তারা আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে নিজেদের পছন্দের লোক নিয়োগ দিয়ে চলেছেন। এমনকি পছন্দের বাইরের কোনো গ্রাহক বিনিয়োগ পুনঃতপশিলের কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না। ব্যাংকের উত্তরা শাখার এস. সূহী নামক বৃহৎ লিমিটধারী এক গ্রাহককে অর্থের বিনিময়ে মাত্র ৭ শতাংশ মুনাফায় বিনিয়োগ নবায়ন করা হয়েছে। যেখানে ব্যাংকের বর্তমান বিনিয়োগ রেট ১২-১৩ শতাংশ। সিদ্ধান্তহীনতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অহেতুক বিলম্ব ও ন্যায়পরায়ণতা না থাকায় ব্যাংকের পুরাতন গ্রাহকরা ব্যাংক ছেড়ে অন্য ব্যাংকে চলে যাচ্ছেন। ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অর্থবছরের ১ তৃতীয়াংশ সময় অতিবাহিত হলেও এখনো নতুন বোর্ড ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ বাজেটটি পাস করতে পারেননি। এ পর্যন্ত পাঁচ-ছয়টি মিটিং করেও তারা সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি। বর্তমান পর্ষদ একের পর এক মিটিং করছে, অথচ সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না। এজন্য তাদের সম্মানী ভাতা বাবদ ব্যয় কয়েকগুণ বেড়েছে। এদিকে আর্থিক খারাপ অবস্থার মধ্যেই ব্যাংকটি সিলেটে টি-২০ আন্তঃক্রিকেট টুর্নামেন্টের জন্য বিপুল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করেছে, যাকে অর্থ অপচয় বলেই মনে করছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা।