ঈদ যাত্রায় সড়কপথে গণপরিবহন চালাতে ডাকাতির ভয়ে আতঙ্কে আছেন বাস মালিকরা। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাস ও পণ্যবাহী যানবাহনে ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবহন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিশেষ করে রাতে দূরপাল্লার বাসে ডাকাতির আশঙ্কা বেশি। দূরপাল্লার বাস মালিকরা বলছেন, ছদ্মবেশে ডাকাতরা যাত্রী হয়ে বাসে উঠে সুযোগ মতো স্থানে চালক ও যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে।
এসব ঘটনায় দূরপাল্লার বাসযাত্রীদের নিরাপত্তা যেমন হুমকিতে, তেমনি মালিকরাও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
গবেষণা ও সচেতনতামূলক প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য রোডের তথ্য মতে, গত আট মাসে সড়ক, রেল ও নৌপথে চার হাজার ৫০৫টি ছিনতাই এবং ২৫৫টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে শুধু সড়কপথে এক হাজার ৮৬৮টি ছিনতাই আর ১১৩টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৬৮ জন।
এ ছাড়া ফুটপাত বা চলার পথে দুই ৪৩২টি ছিনতাই ও ৩৫টি ডাকাতির ঘটনায় এক হাজার ১৭ জন আহত এবং একজন নারীসহ দুজন নিহত হয়েছেন।
প্রতিষ্ঠানটির মহাসচিব শান্তা ফারজানা বলেন, ‘আসন্ন ঈদ যাত্রা ঘিরে এবার শহরের মানুষদের গ্রামের বাড়ি যাওয়ার বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই ঝুঁকি দূর করতে মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কে প্রতি তিন কিলোমিটার পর পর পুলিশ বুথ বা ওয়াচ টাওয়ার, সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা জরুরি। সড়কে টহল পুলিশ বাড়ানোর পাশাপাশি চিহ্নিত বিশেষ বিশেষ স্থানগুলোয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নজরদারি আরো বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য মতে, গত বছর জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত যাত্রীবাহী বাসের সংখ্যা ৫৪ হাজার ৪৭৪। এর মধ্যে আন্ত জেলা বাস প্রায় ২২ হাজার। আর রাজধানী থেকে বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করে প্রায় ১০ হাজার বাস।
সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি সূত্র জানায়, ঈদ ঘিরে রাজধানী থেকে আন্ত জেলায় একটি বাস দিনে অন্তত তিনটি করে ট্রিপ দেবে। দুবার রাজধানী থেকে ছেড়ে যাবে আর একবার রাজধানীতে ফিরে আসবে।
প্রতি ট্রিপে গড়ে ৪০ জন যাত্রী থাকলে ১০ হাজার বাসে দিনে আট লাখ যাত্রী বাসে করে রাজধানী ছাড়বেন। এবার এই বিপুলসংখ্যক যাত্রী পরিবহনের সময় ডাকাত আতঙ্ক নিয়েই যাত্রীসেবা দিতে হবে। আবার সড়কে ডাকাতির ঘটনা ঘটলে ওই বাস পুলিশ জিম্মায় নিয়ে নেওয়া হয়। এতে করে দীর্ঘ সময় বাসটি আর সড়কে নামাতে পারেন না মালিক। এতে বাস মালিক যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন, চালক-সহকারীরাও বেকার হয়ে পড়েন।
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সড়ক-মহাসড়ক, সেতু ও রেলপথের যাত্রীদের যাতায়াত নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে সম্প্রতি আয়োজিত এক আন্ত মন্ত্রণালয় সভায় মহাসড়কে ডাকাতির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওই সভায় জানানো হয়, মহাসড়কে সবচেয়ে বেশি ডাকাতি হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-আরিচা, ঢাকা-সিলেট এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে। বিশেষ করে প্রবাসী যাত্রীরা যেসব বাসে ওঠেন ওই বাসগুলো বেশি মাত্রায় ডাকাতির কবলে পড়ে। এ বিষয়ে সড়ক উপদেষ্টার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
বাস মালিক সমিতি বলছে, যাত্রীবেশে ডাকাতরা বাসে উঠে চালক, সহকারী ও সুপারভাইজারসহ যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-রাজশাহীসহ দূরপাল্লার বিভিন্ন রুটে রাতের বেলায় যাত্রী কমে গেছে। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পরিবহন মালিকরা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ওই মহাসড়কে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা। তাঁরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানীতে আসা এবং রাজধানী থেকে বিভিন্ন জেলায় চলাচল করা বাসেই বেশি ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। এসব বাসে যাত্রীবেশে ডাকাতদলের সদস্যরা উঠে তাদের সহযোগীদের মোবাইলে তথ্য পাঠালে মহাসড়ক থেকে অন্য সহযোগীরাও বাসে উঠে পড়ে। এরপর ডাকাতদলের নির্ধারিত স্থানে বাস পৌঁছালে অস্ত্রের মুখে তারা ডাকাতি সেরে সটকে পড়ে। ডাকাতরা দেশীয় অস্ত্রের পাশাপাশি আধুনিক অস্ত্র দেখিয়ে যাত্রীদের জিম্মি করার পাশাপাশি নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানি পর্যন্ত করছে।
জানা গেছে, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে কয়েকটি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে শিক্ষা সফরের চারটি বাস ডাকাতের কবলে পড়ে। সড়কে গাছ ফেলে ডাকাতদল বাসগুলোয় থাকা শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং শিক্ষকদের মুঠোফোন, টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে যায়। আবার গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানী থেকে ছেড়ে যাওয়া রাজশাহীগামী চলন্ত বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে পরের ছয় মাসে বেশ কয়েকটি ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। মহাসড়কের সীতাকুণ্ড, মীরসরাই, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম ও দাউদকান্দি এলাকায় ডাকাতির এসব ঘটনা বেশি ঘটেছে। রাত্রীকালীন বাসে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ থেকে বগুড়ার শেরপুর এবং রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে শঠিবাড়ী পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট রয়েছে।
বাসচালকরা বলছেন, মহাসড়কে গাড়ি চালানোর সময় ডাকাত আতঙ্কে থাকেন তাঁরা। আগের চেয়ে মহাসড়কে বাসে ডাকাতির ঘটনা বেড়ে গেছে। আসন্ন ঈদ ঘিরে ডাকাতির ঘটনা বাড়লে যাত্রীরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বেন। এর জন্য পুলিশের নজরদারি আরো বাড়ানো জরুরি।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতির কারণে স্বাভাবিকভাবেই গণপরিবহনে ডাকাতির ভয় রয়েছে। শুধু যে মহাসড়কে ডাকাতির ভয়, বিষয়টি এমন নয়। জেলা, উপজেলা পর্যায়ে আঞ্চলিক সড়কেও গণপরিবহনে ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। এভাবে চলতে থাকলে যাত্রীরা নিরাপত্তাহীনতায় পড়বেন।’
হাইওয়ে পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হাইওয়ে পুলিশ মহাসড়কের নিরাপত্তায় প্রতিনিয়ত কাজ করছে। টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ ছাড়া নিরাপত্তার অংশ হিসেবে সম্প্রতি চালু হয়েছে হাইওয়ে পুলিশ স্পেশাল হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর (০১৩২০-১৮২২০০)। ইমারজেন্সি ঘটনা হলে যে কেউ এই নম্বরে ঘটনা জানাতে পারবেন হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও, অডিও পাঠিয়ে কিংবা সরাসরি কল করে। এতে তাৎক্ষণিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সাড়া মিলবে।’
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব সাইফুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঈদ যাত্রার খুশির পথে ডাকাতির মতো ঘটনা সবার জন্য বড় বেদনার। এতে যাত্রীসহ আমাদেরও ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। কিভাবে ঈদ যাত্রা নিরাপদ করা যায় তা নিয়ে হাইওয়ে পুলিশসহ আমরা কাজ করছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘যাত্রীদেরও সচেতন থাকতে হবে। আশপাশের কোনো যাত্রীকে সন্দেহজনক মনে হলে আগে থেকেই হাইওয়ে পুলিশকে তথ্য দেওয়া অথবা কৌশলে চালক বা সহকারীকে তথ্য দিলে সুযোগ মতো টহল পুলিশের সামনে বাস দাঁড় করিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।’