
বছরের পর বছর পাইপলাইনে পড়ে আছে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুত অর্থ। কিন্তু প্রয়োজনে খরচ করা যাচ্ছে না। এর পেছনে রয়েছে ডলার সংকটে এলসি না খোলাসহ ৫৫ বাধা। গত অর্থবছরের (২০২৩-২৪) ১৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বরাদ্দ পর্যালোচনা করে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। এতে দেখা গেছে, বাধাগুলোর অধিকাংশ দীর্ঘদিনের। প্রত্যেক অর্থবছর এসব চিহ্নিত করেই দায় সারে সংস্থাটি। কিন্তু সমাধানের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। প্রতিবেদনটি সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইএমইডির সাবেক সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক অর্থ হোক আর সরকারি অর্থই হোক ঘুরেফিরে একই সমস্যা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো গবেষণা হচ্ছে না। অর্থাৎ কেন এসব সমস্যা হচ্ছে, উত্তরণের উপায় নিয়ে কোনো কাজই হয় না। ফলে গতানুগতিকভাবে একই সমস্যা তুলে ধরা হয় বছরের পর বছর। তিনি বলেন, রাজনৈতিকসহ নানা কারণে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না। যেমন বিশ্বের অন্যান্য দেশে সরকার পরিবর্তন হলেও নীতি একই থাকে। আমাদের দেশে সরকার পরির্তন হলে নীতিরও পরিবর্তন ঘটে। ফলে কেউ এসব সমস্যা সমাধানে সিরিয়াসলি দেখে না বা উদ্যোগও নেয় না।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে মোট বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক অর্থ ছিল ৯৪ হাজার ৩৪ কোটি টাকা, যা মোট এডিপি বরাদ্দের ৩৪ দশমিক ২২ শতাংশ। পরে অর্থবছরের মাঝপথে এসে বৈদেশিক অর্থের অংশে ১০ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা কাটছাঁট করে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছর শেষে সেই টাকারও পুরোপুরি ব্যয় করা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত খরচ হয়েছিল ৭১ হাজার ৯৭৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। ফলে অব্যয়িত থেকে যায় ১১ হাজার ৫২৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈদেশিক অর্থ ব্যয়ে অন্যতম বাধাগুলো হচ্ছে-ডলার সংকটে এলসি খুলতে না পারায় প্রকল্পের মালামাল আনা যায় না। এছাড়া অর্থছাড়ে বিলম্ব, পরামর্শক নিয়োগে দেরি, ডলারের ঊর্ধ্বগতি ও চুক্তি করতে সময় লাগা এবং এমআইএস স্থাপনে বরাদ্দ করা অর্থ দেওয়া সম্ভব না হওয়া। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় কনস্ট্রাকশন ও সুপারিভিশন ফার্ম নিয়োগে দেরি, দরপত্র প্রক্রিয়াকরণ শেষ না হওয়া, বদলিজনিত কারণে প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন এবং নির্ধারিত সময়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারে না। আরও আছে, স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় জনগণের আপত্তির মুখে নির্মাণ কাজ বন্ধ, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে ঠিকাদার কাজ করতে না পারায় তাদের বিল পরিশোধে বিলম্ব এবং বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান না হওয়ায় একটি প্রকল্পে ৪০ হাজার টন পাথর স্পেসিফিকেশন মোতাবেক আনা সম্ভব হয়নি। ফলে তা বাতিল করতে হয়েছিল। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী গাড়ি কেনা ও কর্মকর্তাদের বৈদেশিক প্রশিক্ষণ বন্ধ ছিল। বিশ্ব বাজারে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়া। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী বরাদ্দে ৫০ শতাংশের খরচ বন্ধ রাখা হয়। উন্মুক্ত দরপত্রের কারণে মোট মূল্য থেকে চুক্তিমূল্য কম হওয়ায় ওই অর্থ খরচ না করতে পারা।
গত অর্থবছরের বৈদেশিক অর্থ ব্যয় করতে না পারার আরও কিছু বাধা ছিল। সেগুলো হলো-একটি প্রকল্পের অনাবাসিক ভবনের জন্য পরামর্শকের প্রাক্কলন অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। কিন্তু লিফট ও অন্যান্য ইলেকট্রো মেকানিক্যাল আইটেমের এলসি খোলা সম্ভব হয়নি। প্রকল্পের মাঝপথে স্থাপত্য নকশা পরিবর্তনে কাজের পরিধি কম বা বেশি এবং ভূমি অধিগ্রহণ বিলম্বে নির্ধারিত কাজ করা যায়নি। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টসংক্রান্ত বিল পরিশোধ করা যায়নি। প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে সময়ক্ষেপণ। বাজার দর অনুমোদন না হওয়ায় এক প্রকল্পের দুটি প্যাকেজ বাতিল। বৈশ্বিক মন্দার কারণে অনেক পণ্য আমদানিতে বিলম্ব।
আইএমইডির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অনুকূলে গত অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) বরাদ্দ ছিল প্রায় ২১ হাজার ২২ কোটি টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খরচ হয়েছিল প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো হলো-স্থানীয় সরকার বিভাগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এছাড়া শিল্প মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, পরিকল্পনা বিভাগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। আরও আছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ, নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয় এবং জননিরাপত্তা বিভাগ।