
ক্ষমতার পাশাপাশি পদকের মোহ পেয়ে বসেছিল গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে। আর এই মোহেই প্রচলিত আইনকানুন-রীতিনীতি উপক্ষো করে মিয়ানমার লাগোয়া বাংলাদেশের সীমান্তের দরজা খুলে দিয়েছিলেন তিনি। দেশের মাটিতে আশ্রয় দিয়েছেন রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে। ভবিষ্যৎ সমূহ বিপদের আশঙ্কা ব্যক্ত করে কূটনীতিকসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ওই সময় বারবার এ বিষয়ে সতর্ক করা সত্ত্বেও তা আমলে নেননি শেখ হাসিনা। বরং ওই জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টিকে পুঁজি করে তিনি মানবতার ফেরিওয়ালা সাজেন। ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ নামে একটি ভুয়া উপাধিও নিজের নামের আগে বসান। এখানেই শেষ নয়, নির্যাতিত ও নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ইস্যুটিকে কাজে লাগিয়ে পর্দার অন্তরালে শান্তিতে ‘নোবেল’ পুরস্কার পাওয়ার জন্য রাষ্ট্রের টাকায় দেশ-বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেন। যদিও শেষ পর্যন্ত তার এই চেষ্টা সফল হয়নি। উলটো আরও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের চিরস্থায়ী সর্বনাশ ডেকে আনেন।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল শনিবার যুগান্তরকে বলেন, রোহিঙ্গারা একবার বাংলাদেশে ঢুকতে পারলে আর যে তারা ফেরত যাবে না, বা ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না-এটা সরকারসহ সব মহলেরই জানা ছিল। প্রশ্ন হলো-তাহলে ঢুকতে কেন দিল। এর জবাব পরিষ্কার। মূলত শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন, এ উদ্যোগ নেওয়ার ফলে তিনি খুব সহজে শান্তিতে নোবেল পেয়ে যাবেন। আর কিছু চামচা বিষয়টিকে আরও উসকে দেন। তারা তো শেখ হাসিনাকে নোবেল পুরস্কার পাওয়াটা একরকম নিশ্চিত করে দিয়েছিলেন। এমনকি নোবেল পাওয়ার জন্য লবিস্টও নিয়োগ দেওয়া হয়। মাঝখানে চরম ক্ষতি হয় দেশের। তিনি বলেন, বিপরীতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশকে ভালোবাসে না। তারা উলটো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে-এটা এক রকম নিশ্চিত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে এমনিতেই জনসংখ্যার মাত্রাতিরিক্ত চাপ। খরা, বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন, নদী ভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি দারিদ্র্য এই অঞ্চলের মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। এর সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, লুটপাট, দুর্নীতি, অর্থ পাচারসহ মানবসৃষ্ট নানা সংকট। শেখ হাসিনার গত সাড়ে ১৫ বছরের টানা শাসনামলে এই সংকট বেড়েছে বহুগুণ। উন্নয়নের নামে চলেছে নজিরবিহীন দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থ পাচার। তবে এর বাইরেও দেশকে দীর্ঘমেয়াদে বহুমুখী ঝুঁকিতে ফেলেছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন। উখিয়ার কুতুপালং পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে। দিন দিন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রভাবে কক্সবাজারের স্থানীয়রা এখন নিজভূমিতে পরবাসী। এরসঙ্গে যোগ হয়েছে ইয়াবাসহ মাদকের ভয়াবহ বিস্তার। আর অস্ত্রের ঝনঝনানি, খুনোখুনিসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঠিক পরিসংখ্যানতো গুনে শেষ করা যাবে না।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির এ প্রসঙ্গে শনিবার যুগান্তরকে বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে বহুমুখী উদ্যোগ নিতে হবে। বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, এই সংকট মোকাবিলায় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে ঢিমে গতি লক্ষ্য করা গেছে। হয়তো এর পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে, তবে যে কারণই হোক এ সমস্যা সমাধানের বিকল্প নেই।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ঘিরে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ঘুরপাক খাচ্ছে। ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে এ অঞ্চলে ইন্দো-প্যাসিফিক নিরাপত্তাবলয় তৈরি করতে প্রভাবশালী কয়েকটি রাষ্ট্র যে বৃহৎ পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সেখানে রোহিঙ্গাদেরও ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা হতে পারে।
এদিকে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের মধ্যে গোপনে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এদের মধ্য থেকে কয়েকটি টিমকে পুনর্বাসনের নামে বিদেশে নেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ শনিবার যুগান্তরকে বলেন, রোহিঙ্গা সংকট আমাদের জন্য অবশ্যই একটি বড় সংকট। এই সংকট মোকাবিলায় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। প্রয়োজনে একটি মাস্টার প্ল্যানের আওতায় এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। তা না হলে এটি আমাদের জন্য একটি স্থায়ী সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
মূলত মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে পালিয়ে আসার ঘটনা সেই ১৯৪২ সালে, ব্রিটিশ আমল থেকে। স্বাধীনতার পরেও বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ২০১৭ সালের আগে প্রায় সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। তবে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী আসে ২০১৭ সালে শেখ হাসিনার শাসনামলে, আর এ ঘটনা ঘটে তার প্রত্যক্ষ মদদে। সরকারি হিসাবে, বাংলাদেশে বর্তমানে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লাখেরও বেশি। এর মধ্যে ৮ লাখ রোহিঙ্গা এসেছে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় ৩৪টি স্বীকৃত ক্যাম্পে এরা বসবাস করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার থেকে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে আহ্বান জানিয়েছিলেন। যে কারণে স্রোতের মতো এসে তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারে এক জনসভায় শেখ হাসিনা বেশ গর্ব করে বলেন, ‘আমরা ১৬ কোটি মানুষকে খাবার দেই। সুতরাং বিপদে পড়ে আমাদের দেশে আসা দুই-পাঁচ-সাত লাখ রোহিঙ্গাকে খাবার দেওয়ার ক্ষমতাও আমাদের আছে।’ এর কিছুদিন পর গণভবনে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন লায়ন্স ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার ছোট বোন শেখ রেহানা আমাকে বলেছিল, ১৭ কোটি মানুষকে তুমি ভাত খাওয়াতে পারছ, আর কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে পারবে না? আমি বলেছিলাম, অবশ্যই পারব। তাদের আশ্রয় দিয়েছি।’ শেখ হাসিনা এভাবে প্রকাশ্যে আহ্বান না জানালে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি অন্যরকম হতো বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মুখে মানবিকতার কথা বললেও শেখ হাসিনার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল একেবারেই ভিন্ন। মূলত তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগতভাবে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বিশেষ করে এই বিষয়টিকে পুঁজি করে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গায় দেনদরবার করেন। দেশের টাকায় বিদেশি গণমাধ্যমে শেখ হাসিনা তার পক্ষে কলাম লেখান। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার এই আকাঙ্ক্ষা শেখ হাসিনার মধ্যে এর আগেও দেখা গেছে। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এসে পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর অনেকটা তড়িঘড়ি করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সঙ্গে চুক্তি করেন তিনি। যার নাম দেওয়া হয় ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’। শেখ হাসিনা সে সময় এই চুক্তিটি কাজে লাগিয়ে ‘শান্তিতে নোবেল পুরস্কার’ পাওয়ার জন্য বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেন। বিদেশে ব্যাপক প্রচারণা চালান। ১৯৯৮ সালে ইউনেস্কো তাকে এজন্য ‘হুপে-বোয়ানি’ শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে। এতে করে তিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আরও উৎসাহী হয়ে ওঠেন। যদিও ওই যাত্রায় প্রাপ্তি না মেলায় পরে রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। পরিসংখ্যান বলছে, দীর্ঘ ২১ বছরের শাসনামলে শেখ হাসিনা প্রায় ৪২টি পদক নিয়েছেন, যার বেশিরভাগই ম্যানেজ করা।
জানা গেছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেই ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রেহিঙ্গা শরণার্থীদের বড় অংশকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এর মধ্যে ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এবং পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শাসনামলে কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশ ফেরত পাঠায়। কিন্তু শেখ হাসিনার শাসনামল থেকে এই প্রক্রিয়া থমকে যায়। বাংলাদেশ সরকার বলছে, হতাশ রোহিঙ্গারা জড়াচ্ছেন বিভিন্ন অপরাধে, রয়েছে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার শঙ্কাও। স্থানীয় প্রতিবেশ ও পরিবেশও পড়েছে বিপন্ন হওয়ার হুমকিতে। তথ্য বলছে, বিশাল এ জনগোষ্ঠীর জন্য মানবিক সহায়তা কমে গেছে ব্যাপকমাত্রায়। খাদ্য সহায়তা কমানোর পথে হাঁটতে হয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থাকেও। দাতা সংস্থাগুলো প্রথমদিকে ব্যাপকভাবে সাহায্য-সহযোগিতার জন্য হাত বাড়ালেও এখন তারা মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে।
সীমান্ত ও ক্যাম্প নিয়ে কাজ করা উচ্চপর্যায়ের একজন সরকারি কর্মকর্তা শনিবার এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, মিয়ানমার থেকে মাদক চালানের সঙ্গে অস্ত্রও আসছে। রোহিঙ্গারা এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। তারা অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করছে। এতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। মাদক ব্যবসা করছে। সারা দেশে মাদক ছড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, অধিকাংশ রোহিঙ্গা ক্যাম্প পাহাড়ি এলাকায়। সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের গুদামও সেখানে। রাতে জনপদে নেমে আসে ডাকাতিসহ খুন-খারাবি করতে। এমনকি পেশাদার এসব খুনি চুক্তিতে খুনের কাজ করে। হত্যা শেষে আবার চলে যায়। খুন-জখম, মাদক, মানব পাচার, চাঁদাবাজি, অপহরণ-দোকান বাণিজ্য এবং আধিপত্য বিস্তার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখন নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।