
মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের কড়া সমালোচনা করে ‘বিশ্ববাসীকে উদ্যোগী হওয়ার’ আহ্বান জানিয়ে মরক্কোতে বাংলাদেশের সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রদূত হারুন আল-রশিদ ফেইসবুকে যে পোস্ট দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
শুক্রবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রণালয় বলেছে, মন্ত্রণালয়ের আদেশ উপেক্ষা করে সদর দপ্তরে না ফিরে অটোয়ায় গিয়ে তার এই রচনা ‘গোপন এজেন্ডা বা অভিসন্ধির ইঙ্গিত দেয়’।
‘বিদেশে সহানুভূতি অর্জনের অভিপ্রায়ে’ তিনি এ ধরনের পোস্ট দিয়েছেন বলেও মনে করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে বর্তমান বাংলাদেশে বিরাজমান পরিস্থিতি এবং বাস্তবতাকে সম্পূর্ণরূপে বিকৃত উপস্থাপন করে ফেসবুকে এ ধরনের লেখা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য এবং এর বিষয়বস্তু গভীরভাবে উদ্বেগজনক। এ ধরনের লেখা গোপন উদ্দেশ্য বা অসৎ অভিসন্ধির ইঙ্গিত দেয়।”
হারুন আল-রশীদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ, “বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে মন্ত্রণালয়ে যোগদানের পরিবর্তে তিনি কানাডায় চলে যান এবং সেখান থেকে ফেইসবুকে লেখালেখি শুরু করেন। তিনি তার ফেইসবুক পোস্টের মাধ্যমে নিজেকে 'নির্যাতিত কূটনীতিক', 'নির্বাসিত ঔপন্যাসিক' ও 'ধর্মনিরপেক্ষ' হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা মূলত বিদেশে সহানুভূতি অর্জনের অভিপ্রায়ে করা হয়েছে।
“পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে তার এবং তার পরিবারের পাসপোর্টসমূহ বাতিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। মন্ত্রণালয় মোহাম্মদ হারুন আল-রশীদের এমন কর্মকাণ্ডের জন্য প্রয়োজনীয় বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
“মন্ত্রণালয় কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এ ধরনের কর্মকাণ্ড প্রশ্রয় দেয় না এবং ভবিষ্যতেও যারা এ ধরনের কর্মকাণ্ড করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে।”
ফেইসবুকে পোস্ট করার কথা তুলে ধরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, “তিনি আগের নিপীড়ক ফ্যাসিবাদী সরকারের গুণকীর্তনের পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ৫ অগাস্ট পরবর্তী বাংলাদেশের পরিস্থিতি নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে প্রমাণ করার অপচেষ্টা করেছেন।
হারুন আল-রশীদ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসসহ অন্তর্বর্তী সরকারের ‘বিভিন্ন উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাসহ বাংলাদেশের সামগ্রিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা করেছেন’ বলেও অভিযোগ করা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।
কী লিখেছেন হারুন
বাংলাদেশ সময় শুক্রবার ভোর ৬টায় ফেইসবুকে ‘বাংলাদেশ এবং আমার নিজের জন্য একটি নিবেদন’ শীর্ষক একটি পোস্ট দেন কূটনীতিক হারুন আল-রশিদ। ওই পোস্টের নিচে নিজেকে ‘নির্যাতিত বাংলাদেশ কূটনীতিক, ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক’ হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি।
ওই পোস্টের ‘বিষয়’ হিসেবে তিনি লিখেছেন, ‘ইউনূসের অধীনে নৈরাজ্যে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ, বিশ্ববাসীর নীরবতা কষ্টদায়ক’।
কয়েকটি অংশে বিভক্ত করে দেওয়া ওই পোস্টে ‘নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের চালানো বর্বরতায় বাংলাদেশ খাবি খাচ্ছে’ বলে অভিযোগ করেন হারুন আল-রশিদ। ‘লাখ লাখ মানুষ মৃত্যু আর নির্বাসন কিংবা উগ্রবাদীদের কাছে নত হওয়াকে বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে’ বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।
ইউনূসের অধীনে বাংলাদেশে ‘ব্যাপক উগ্রবাদের বিস্তার ঘটেছে’ অভিযোগ করে রাষ্ট্রদূত লেখেন, “সংখ্যালঘু এবং ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিরা অব্যাহত ভয়ের মুখে বসবাস করছে। যেখানে হিযবুত তাহরীর, আইএস এবং আল-কায়েদা তাদের লাল-কালো পতাকা প্রদর্শন করছে; প্রকাশ্যে চাচ্ছে ইসলামি শাসন। সরাসরি তাদের নেতৃত্ব থেকে এসেছে জুলাই-অগাস্টের সন্ত্রাসীরা।
“কিন্তু ইউনূস তাদের কেবল রক্ষা করেনি, ক্ষমতায়নও করেছেন। তার সরকার সন্ত্রাসীদের মন্ত্রী বানিয়েছেন এবং যাদের বানাতে পারেনি, তাদেরকে রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ করার মাধ্যমে উৎসাহিত করেছে।”
তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন সদ্য বিদায়ী এ রাষ্ট্রদূত।
কয়েকটি ফেইসবুক পোস্টের দাবির সূত্র ধরে গত অক্টোবরের শেষে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছিল, প্রধান উপদেষ্টার তখনকার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সদস্য।
ওই সময় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় বলেছিল, মাহফুজ আলম হিযবুত তাহরী বা অন্য কোনো নিষিদ্ধ বা ইসলামপন্থি গোষ্ঠীর সদস্য নন। বিভিন্ন পত্রিকায় ফ্যাক্টচেকিংয়ের সূত্র ধরে ওই খবরকে ‘গুজব’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল।

হাসিনা ও ইউনূস সরকারের তুলনা করে হারুন লিখেছেন, স্বাধীন-নিরপেক্ষ তদন্ত করলে ইউনূসের ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন জঘন্য সত্য’ বেরিয়ে আসত। শেখ হাসিনাকে অপসারণের পর ইউনূসের ‘তত্ত্বাবধানে’ ১৫ দিনে যা ঘটেছে, তা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পুরো ১৫ বছরের শাসনকালের ঘটনাকে ‘ছাড়িয়ে যেত’।
রাষ্ট্রদূত লেখেন, “মরক্কোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসাবে আমাকে ‘বিচ্ছিন্ন’ করা হয়েছে। আমার অপরাধ, বঙ্গবন্ধুর প্রাথমিক জীবন (১৯২০-১৯৪২) নিয়ে বাংলা উপন্যাস লেখা, যার সঙ্গে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের কোনো সম্পর্ক নেই।
“আমাদের ইতিহাসের প্রতি ইউনূসের ঘৃণা কেবল অবমাননা নয়। এটা বাংলাদেশের ভিত্তিমূলকে মুছে দিতে ধারাবাহিক ও হিসেবি প্রচেষ্টা।”
বিশ্ববাসীর কাছে আহ্বান জানিয়ে তিনি লিখেছেন, “ইউনূসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের শত শত উদাহরণ আমি দিতে পারব। এটা কেবল কথার কথা নয়, এখানকার সব দাবি প্রকাশিত এবং প্রমাণযোগ্য। উপেক্ষা করলে সত্য মুছে যায় না।”
হারুন লেখেন, “ইউনূসকে নিবৃত্ত করতে পশ্চিমাদের দায়িত্ব দ্বিগুণ, কারণ তিনি তাদের অনুগত একজন হিসেবেই খ্যাতি পেয়েছেন। ইতিহাসে কোনো নোবেল বিজয়ী কি এমন নিষ্ঠুরতায় প্রধান ভূমিকা রেখেছে?
“ইতিহাস ইউনূসকে মনে রাখবে। তবে নায়ক হিসাবে নয়, বরং এমন এক আত্মসাৎকারী হিসাবে, যিনি বিশ্বকে ধোঁকা দিয়েছেন এবং সন্ত্রাসবাদে পতিত হয়েছেন। নিজের জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার মাধ্যমে তিনি অপমান করেছেন পশ্চিমাদেরও, যারা এখনও তাকে প্রণোদনা দেয়।”
তিনি লেখেন, “এটা কোনো কূটনৈতিক নোট নয়। এটা এক ব্যক্তির মৌলিক ও জরুরি আর্তনাদ, যার দেশ চুরি হয়ে গেছে; কেবল লেখালেখির জন্য, ইতিহাস মনে রাখার জন্য এবং সত্যটা বলার জন্য ইউনূসের শাস্তির মুখে যার জীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।”
তিনি বলেন, “আজ আমি বুনো অবস্থা থেকে মুক্তি প্রত্যাশী একজন ভাষাহীন, নির্যাতিত কূটনীতিক ও নির্বাসিত ঔপন্যাসিক।
“কিন্তু আগামীকাল হয়ত আপনাদের নিরবতা, আপনাদের উদাসীনতার নিন্দা ইতিহাস করবে। এখনই শুনুন, কেবল আমার কথা নয়, বরং লাখ মানুষের কথা, যাদের আর্তি আজ ইউনূসের রক্ত ও মিথ্যার নিচে চাপা পড়েছে।”
কে এই হারুন আল রশিদ?
২০২৩ সালের অক্টোবরের শুরুতে আফ্রিকার দেশ মরক্কোতে হারুন আল-রশিদকে রাষ্ট্রদূত করে পাঠায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ২০তম বিসিএসের পররাষ্ট্র ক্যাডারের এ কর্মকর্তা ওই সময় কানাডায় উপ হাই কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন।
২০০১ সালে ফরেন সার্ভিসে যোগ দেওয়া হারুন এর আগে রোম, কায়রো, মেক্সিকো সিটি ও মাদ্রিদে বিভিন্ন কূটনৈতিক দায়িত্বে ছিলেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন পদ সামলানোর ধারাবাহিকতায় জনকূটনীতি অনুবিভাগে মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালনের সময় অটোয়া মিশনে পাঠানো হয় তাকে।
গত অগাস্টে সরকার পরিবর্তনের পর ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ হিসাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যেসব কর্মকর্তাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন এই কূটনীতিক।
সে সময় শেখ ফজিলাতুন্ নেসা মুজিবকে নিয়ে হারুন আল রশিদের লেখা ‘রেণুর আবির্ভাব’ উপন্যাসের প্রচ্ছদও অভিযোগের পক্ষে কারণ হিসাবে দেখানো হয়। কথা সাহিত্যিক-অনুবাদক হারুনের বেশ কয়েকটি বই রয়েছে।
হারুনের ‘আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতা’ নিয়ে ওই আলোচনার মধ্যে ডিসেম্বরে সদরদপ্তরে ফিরতে বলা হলেও তিনি যে ফেরেননি, তার আদ্যোপান্ত তুলে ধরা হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, “হারুন আল-রশিদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ১১ ডিসেম্বর দেশে প্রত্যাবর্তন ও অনতিবিলম্বে মন্ত্রণালয়ে যোগদানের জন্য আদেশ দিয়েছিল।
“এ সত্ত্বেও তিনি তার পদে বহাল থেকে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব ত্যাগ করেন। বাংলাদেশে ফিরে আসার পরিবর্তে তিনি বিভিন্ন অজুহাতে তার যাত্রা বিলম্বিত করেন।”
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই তিনি মরক্কোর রাবাত থেকে কানাডার অটোয়ায় চলে গেছেন বলে জানা গেছে। গত ৬ মার্চ ২০২৫ তারিখে তার অটোয়া থেকে ঢাকায় ফিরে আসার কথা থাকলেও তিনি ফেরত আসেননি।”