Image description
ট্রাইব্যুনালে শুনানি শুরু হয়ে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত টানা চলছে না। ১৮০ দিনের মধ্যে বিচারকার্য সমাপ্ত করার বিধানও মানা হচ্ছে না।

২০১৭ সালের ১৭ জুলাই বগুড়ার শ্রমিক লীগের নেতা তুফান সরকার এবং তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে এক ছাত্রীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। পরে ধর্ষণের শিকার ছাত্রী ও তার মাকে মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয় এবং রড দিয়ে নির্যাতন করা হয়। ২৯ জুলাই ওই ছাত্রীর মা বগুড়া সদর থানায় ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগ এনে দুটি মামলা করেন। ২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আলোচিত এই মামলা দুটিতে প্রধান আসামি তুফান সরকারসহ ১০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। বাদী ও ভুক্তভোগী ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিচার শেষ হয়নি।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এ (সংশোধিত ২০০৩) বিচার সম্পর্কে ২০(১) ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন কোনো অপরাধের বিচার কেবলমাত্র নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারযোগ্য হবে। উপধারা (২)-এ বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনালে মামলার শুনানি শুরু হলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি কর্মদিবসে একটানা চলবে।

উপধারা (৩)-এ বিচারের জন্য মামলাপ্রাপ্তির তারিখ হতে একশত আশি দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল বিচারকার্য সমাপ্ত করবেন।

আইনে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও তুফান সরকারের বিরুদ্ধে দায়ের করা এই মামলায় অভিযোগ গঠনের ৫ বছরেও বিচার শেষ হয়নি। আবার প্রতি কর্মদিবসে টানা মামলা চলার কথা থাকলেও সেটাও পালন করা হয়নি এই মামলায়।

এ মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি না করায় আইনের বিধান মানা হয়নি। আবার হাইকোর্টের নির্দেশনাও উপেক্ষিত হয়েছে।

২০১৯ সালের ১৯ জুলাই একটি ধর্ষণ মামলার জামিন শুনানি শেষে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ আদেশ দেন ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। উচ্চ আদালতের নির্দেশ নিম্ন আদালতের জন্য মানা বাধ্যতামূলক বলে সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদে বলা হলেও তা মানা হয়নি এই মামলার ক্ষেত্রে।

শুধু তুফানের মামলার ক্ষেত্রেই নয়, বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণের যেসব মামলা বিচারাধীন, সেগুলোর বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না আইন ও হাইকোর্টের ওই নির্দেশ।

সাম্প্রতিক সময়ে নারী ও শিশুদের প্রতি নৃশংসতার ঘটনা অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। মূলত বিচারহীনতা ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণেই এসব ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন আইনজীবীরা। এ ধরনের সহিংসতার দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে পারলে এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে নারী ও শিশুর প্রতি নৃশংসতা কিছুটা হলেও কমত বলে মনে করেন তাঁরা।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাহবুবুর রহমান বলেন, বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় সাক্ষীদের খুঁজে পাওয়া যায় না। মামলাকে দুর্বল করে। বাদী মামলা পরিচালনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে; যে কারণে বেশির ভাগ আসামি খালাস পেয়ে যায়। মামলায় শেষ পর্যন্ত কিছু হয় না—এই ধারণা নিয়েই অপরাধীরা ধর্ষণের মতো অপকর্ম এবং নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে। আইনের বিধান মেনে নির্দিষ্ট সময়ে মামলা শেষ করতে পারলে এই নৃশংসতা রোধ করা সম্ভব হবে।

দেশে ধর্ষণের মিথ্যা মামলা দিয়েও হয়রানি করা হচ্ছে অনেককে। বছরের পর বছর এসব মামলা চলার কারণে মিথ্যা মামলায় যারা আসামি, তারাও মামলায় পড়ে হয়রানি ও নিঃস্ব হচ্ছে। ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে উভয় পক্ষ।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান হাউজিংয়ের জামিয়া আরাবিয়া আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক জহিরুল ইসলাম তাঁর ৯ বছরের এক ছাত্রকে ধর্ষণ করেন—এই অভিযোগে ২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মামলা হয় মোহাম্মদপুর থানায়। প্রায় এক বছর পর ২০২২ সালের ২৯ জানুয়ারি ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ওই বছরই ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন। বর্তমানে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৬-এ মামলাটি বিচারাধীন। গত তিন বছরে একজন সাক্ষীও আদালতে হাজির হননি। তাই বিচার নিষ্পত্তিও হয়নি।

সাক্ষী হাজির না হলে করণীয় কী, সে সম্পর্কে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। মামলা নিষ্পত্তির জন্য ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই হাইকোর্ট সাতটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি হলো—ধার্য তারিখে সাক্ষীর উপস্থিতি ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতি জেলায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন), সিভিল সার্জনের একজন প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটরের সমন্বয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করতে হবে। মনিটরিং কমিটি সাক্ষীদের উপস্থিত করা নিশ্চিত করবে। কিন্তু মনিটরিং কমিটির কার্যকারিতা নেই বললেই চলে।

সারা দেশে ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৬ হাজার ৩০৫টি। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির এক হিসাবে এই সংখ্যা দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সাল পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের হিসাব অনুযায়ী, দেড় লাখ ধর্ষণের মামলা বিচারাধীন রয়েছে। পাঁচ বছরের পুরোনো মামলা রয়েছে কয়েক হাজার।

গত কয়েক দিনে ধর্ষণের নৃশংসতা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ও ধর্ষণের সঙ্গে নৃশংসতার ঘটনা জনসাধারণকে আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসছে মানুষ। ধর্ষণের বিচার নিয়ে নতুন করে ভাবছে সরকার। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন ৯০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার এবং ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করার।

বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন এ প্রসঙ্গে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আইনের বিধান ও উচ্চ আদালতের নির্দেশ যাতে যথাযথভাবে কার্যকর হয়, সে জন্য সুপ্রিম কোর্টসহ জড়িত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় থাকতে হবে। ট্র্যাকিংও থাকতে হবে। যদি সেগুলো না থাকে, তাহলে যা হওয়ার তা-ই হবে।’

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফৌজিয়া মোসলেম বলেন, বিলম্ব বিচার ও বিচার না হওয়ার দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি এ ধরনের অপরাধ বাড়ার একটি কারণ।

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও ফৌজদারি মামলা পরিচালনাকারী বিশিষ্ট আইনজীবী মো. বোরহানউদ্দিন বলেন, আইনে বিচারের সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা না মানারও কোনো সুযোগ নেই। যদি আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা কেউ না মানে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কারণ, এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা।