Image description

শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতি সভা ডেকে আদালত-সংক্রান্ত সেবার জন্য নিয়মবহির্ভূত অর্থ দেওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। সেবা ধরে ধরে ‘ঘুষের’ অঙ্ক নির্ধারণ করা হয়েছে এতে। বিষয়টিকে ‘ঘুষকে বৈধতা দান’ হিসেবে বিবেচনা করে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

বিষয়টি অস্বীকার না করে আইনজীবী সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম কাশেম বলেছেন, ঘুষের পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে ও হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আইনজীবী সমিতির রেজল্যুশনের (সিদ্ধান্ত) ‘অংশবিশেষ’ ভাইরাল হলে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। আইনজীবীদের সংগঠনের এ সিদ্ধান্তকে নজিরবিহীন আখ্যা দিয়ে বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ ও খাটো করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন শরীয়তপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নাজির শেখ মহসিন স্বপন।

শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান স্বাক্ষরিত ভাইরাল হওয়া রেজল্যুশনের অংশবিশেষে দেখা যায়, আদালতের সেবার জন্য বিভিন্ন হারে অর্থ দেওয়ার সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। সমিতির এ নির্বাহী সভা ৬ মার্চ দুপুরে সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম কাশেমের সভাপতিত্বে সমিতি ভবনের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত হয়।

গৃহীত সিদ্ধান্তের (২ থেকে ৫) তালিকায় বলা হয়: পেশকার/পিয়নকে

সিআর (নালিশি) ফাইলিংয়ে ১০০ টাকার বেশি দেওয়া হবে না। যেকোনো দরখাস্তে জিআর/সিআর ১০০ টাকার বেশি দেওয়া হবে না। জামিননামা দাখিলের খরচ মামলাপ্রতি ১০০ টাকার নিচে হবে না এবং ২০০ টাকার বেশি হবে না। গারদখানায় ওকালতনামায় স্বাক্ষরে ১০০ টাকা, সিভিল ফাইলিংয়ে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা ও হলফনামায় ১০০ টাকা দেওয়া হবে।

শরীয়তপুরের নাগরিক সমাজ বিষয়টিকে ঘুষকে দাপ্তরিকভাবে বৈধতা দেওয়ার শামিল হিসেবে দেখছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের জেলা শাখার সভাপতি অ্যাড. রাশিদুল হাছান বলেন, ‘শরীয়তপুর আইনজীবী সমিতি এ ধরনের কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোন এখতিয়ার তাদের নেই। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। আমি এর নিন্দা জানাই।’

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন শরীয়তপুর জেলা শাখার সভাপতি মাসুদুর রহমান বলেন, ‘এভাবে সভা ডেকে রেজল্যুশন করে ঘুষের অঙ্ক নির্ধারণ করা বেআইনি। আমি এটা কখনোই সমর্থন করি না। আমি এর নিন্দা করছি।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শরীয়তপুর জেলা শাখার আহ্বায়ক ইমরান আল নাজির তাঁর ফেসবুকে রেজল্যুশনের অংশবিশেষ পোস্ট করে সেখানে লিখেছেন, ‘ঘুষের সার্টিফিকেট দিল শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতি।’

শরীয়তপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নাজির শেখ মহসিন স্বপন এ নিয়ে বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আইনজীবী সমিতি সভা ডেকে ঘুষের পরিমাণ নির্ধারণ করে এ ধরনের রেজল্যুশন ভাইরাল করায় আমরা বিস্মিত হয়েছি। এটা নজিরবিহীন। ঘুষকে রেজল্যুশন আকারে বৈধতা দেওয়া হয়... এটা কোনো ইতিহাসে নাই। এটা করে তাঁরা বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ ও খাটো করেছেন। তাঁরা এ কাজটা ঠিক করেন নাই। ৫ আগস্টের পরে এ ধরনের লেনদেন টোটালি বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের জজ স্যার, চিফ স্যার এ ব্যাপারে সোচ্চার রয়েছেন। কোনো ফাইল বা কোনো কাজ আটকে থাকছে না। তাহলে কেন আমাদের স্টাফদের ঘুষের আওতায় আনা হলো, আমি জানতে চাই।’

শরীয়তপুর কোর্ট পরিদর্শক শিমুল সরকার বলেন, ‘জানতে পারলাম আইনজীবী সমিতি মিটিং করে ঘুষের রেট নির্ধারণ করেছে। এটা তাদের বিষয়। তারা এ বিষয়ে আমাকে এখনো কিছু জানায়নি। আমাদের এখানে ঘুষ নেওয়ার সঙ্গে কেউ জড়িত আছে কি না তা-ও আমার জানা নেই। এ রকম যদি কেউ ঘুষ নিয়ে থাকে, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম কাশেম বলেন, ‘শরীয়তপুর কোর্ট-কাচারিতে দীর্ঘদিন ধরে ঘুষ নেওয়ার রেওয়াজ চলে আসছে। কোর্টের কর্মচারীরা ইচ্ছেমতো যার থেকে যা পারছে আদায় করে নিচ্ছে। আমরা চাচ্ছি, এটা বন্ধ হোক। যেহেতু এটা একবারে হুট করে বন্ধ করা যাবে না, তাই সভায় ঘুষের পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে নির্দিষ্ট হারে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যাতে আমরা কেউ হয়রানির শিকার না হই। ভবিষ্যতে আমরা এই অনৈতিক লেনদেন পুরোপুরি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেব।’

উল্লেখ্য, গত ১২ ফেব্রুয়ারি শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের প্রার্থীরা প্যানেলের ১৫টি পদের প্রতিটিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।