
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মাস্টার্স এর ছাত্র। দিনটি ছিল ২০১৩ সালের মার্চ মাসের ৩ তারিখ সকাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম সমবর্তনের তারিখ নির্ধারিত ছিল ৪ মার্চ ২০১৩, তার ঠিক আগের দিন। আমার সেই সমাবর্তনে অংশ নেয়ার কথা। আগের দিন ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ থেকে সমাবর্তনের কস্টিউমস গুলো নিয়ে এসেছিলাম। আমরা বন্ধুরা ঠিক করেছিলাম সমাবর্তনের আগের দিন আমরা আমাদের কস্টিউমস গুলো পরে আমরা আমাদের ডিপার্টমেন্টে এবং বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন জায়গায় একত্রে ছবি তুলবো। সকাল নয়টা দশটা নাগাদ আমাদের সবার ছবি তুলতে যাওয়ার কথা।২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দুই সপ্তাহ যখন গণজাগরণ মঞ্চের খুব জমজমাট অবস্থা শাহবাগে, সেই সময়টাতে আমি বেশিরভাগ সময়ে ইউনিভার্সিটিতে ছিলাম না। ঢাকা শহরেই ছিলাম না মূলত। সমাবর্তনে অংশ নিব বলে গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে হলে উঠেছিলাম সমাবর্তনের তিন-চারদিন আগে। গণ জাগরণ মঞ্চের উত্থানে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হলগুলোতে চলতেছিল যাকে তাঁকে শিবির কর্মী সন্দেহে ধরে নির্মম নির্যাতন, যার কিছুই জানতাম না আমি। তখন এসব নিয়ে রিপোর্ট করার সাহসও হয়তো ছিলনা কোন সাংবাদিকের।ঘটনার দিন খুব সকালবেলা আমাকে ফোন দেয় আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু। আমি যতটুকু জানি ও আওয়ামী পরিবারের সন্তান, হলে বড় কোন পোস্ট হোল্ড না করলেও ছাত্রলীগ সমর্থন করত এইটুকু জানতাম। ও আমাকে ফোন দিয়ে জানায়, আমি যেন হলে না থাকি, এই মুহূর্তে হলে থাকলে নির্যাতনের আশঙ্কা আছে। আমি ওকে কেন হল ছেড়ে যেতে হবে এই প্রশ্ন করলে ও জানায় যে হলে ছাত্রলীগ কর্মীরা সন্দেহভাজন ছাত্রশিবিরের কর্মীদের খুঁজে খুঁজে বের করে মারপিট করছে। আমি বললাম আমি তো বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ছাত্র রাজনীতিতে অংশগ্রণ করিনি, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরে কোন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্টতা ছিল না। তবে হলে উঠার শুরুতে ছাত্রলীগের অনেক মিছিল মিটিং এর বাধ্য হয়ে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিল। এ পর্যন্তই। ও আমাকে বলল যদি কোন অন্য কোন ছাত্র রাজনীতি না করো তাহলে থাকতে পারো।
তবুও আমি কিছুটা ভড়কে গেলাম। আমার কাছে মূল্যবান জিনিস বলতে তখন আমার মোবাইল আর ল্যাপটপটি ছিল। আমার ল্যাপটপের ব্যাগটা নিয়ে হল থেকে বের হয়ে আসলাম এবং শামসুন্নাহার হলে আমার এক ছোট বোনের কাছে আমার ল্যাপটপের ব্যাগটা দিয়ে একা একা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে হাটতে লাগলাম।
এস এম হলের সামনের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বঙ্গবন্ধু হলের আমার এক ছোট ভাই সাঈদকে ফোন দিলাম যে তখন ছাত্রলীগের অনেক বড় নেতা। আমি যখন আলীমে মাদ্রাসায় পড়তাম তখন ও আমার এক বছর জুনিয়র ছিল। আমরা একই মাদ্রাসায় পড়তাম, এবং আমাদের বাড়ি একই থানায় অর্থাৎ মোড়েলগঞ্জে। সেই সময় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিল আমাদের মোড়েলগঞ্জ এর সদ্য পদলুপ্ত এমপি বদিউজ্জামান সোহাগ ভাই। সোহাগ ভাই মোড়েলগঞ্জের ছেলে এবং সাঈদও মোড়েলগঞ্জ এর ছেলে সেই সুবাদে সাঈদ তখন ছাত্রলীগের ভালো একটা পোস্ট হোল্ড করতো। আমি ওকে সবকিছু জানিয়ে ফোন দিলাম, ও আমাকে বলল, আপনার হলের ছেলেরা এরকম করলে আমি কি করতে পারি? আমি তখন অবাক হয়ে শুনলাম। এবং ভাবলাম একজন ছাত্র নেতার নেতৃত্বের গুণাবলীর কথা। যে কিনা বিপদে পড়া একজন মানুষকে উদ্ধার করার কোন চেষ্টা না করে কিংবা ভিন্ন কোন পরামর্শ না দিয়ে সে বলল আমি কি করতে পারি! (সাঈদ এখন ইসলামী ব্যাংকে খুব সম্ভবত অফিসার পদে কর্মরত আছে)।
অনেক কষ্ট পেলাম এবং মনের মধ্যেও একটু জেদ চাপলো। ভাবলাম আমার যেহেতু আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ছাত্র রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করিনি সেহেতু কিছুটা সাহস সঞ্চার করে আমি আবার হলে গেলাম রুম থেকে সমাবর্তনের কস্টিমসগুলো নিয়ে আসার জন্য। রুমে ঢুকে আমি প্যান্ট শার্ট পরলাম, পায়ে সু পরলাম, কস্টিউমস গায়ে জড়ালাম। ইতোমধ্যে কয়েক মিনিটের মধ্যে ছাত্রলীগের কর্মীরা হাজির। দেখলাম এদের কাউকেই চিনি না। আমি তখন মাস্টার্সের ছাত্র; মানে তখন হলের অধিকাংশই আমার জুনিয়র। দেখলাম, যারা আমাকে নিতে এসেছে এরা অধিকাংশই সম্ভবত প্রথম বর্ষ এবং দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের কর্মী। আমি ২০০৯ সাল থেকে হলে থাকতাম। হলের ডিবেটিং ক্লাব, বাঁধন, হল মেসে নানা সময়ে দ্বায়িত্ব পালন করেছি, নানা প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতাম যে কারণে হলের সবার সাথে সখ্যতা ছিল। এজন্যই হয়তো যারা একদম জুনিয়রদের পাঠিয়েছিল আমাকে তুলে নিতে।
ওরা বলল, আপনাকে ভাই ডেকেছে। আমি বললাম, ঠিক আছে চলো। গেটের কাছে মেইন বিল্ডিং এ ঢোকার আগে আমার অর্থনীতিতে পড়া বন্ধু কবিরের সাথে দেখা। কবির তখন হল ছাত্রলীগের নেতা। কবির আমাকে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে গেল, বলল তুই স্বীকার কর তাহলে তোকে ছেড়ে দিব। আমি বললাম আমি কি স্বীকার করব? বললো তুই যদি অন্য কোন ছাত্র সংগঠন করিস তাহলে সেটা আমার কাছে বল। আমি জোর গলায় বললাম আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ছাত্র রাজনীতিতে অংশগ্রণ করিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর আমি শুধুমাত্র ডিবেটিং ক্লাব ও বিএনসিসি নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি। ও বললো তাহলে ভাইয়ের কাছে চল। আমি বললাম ঠিক আছে চল। ও আমাকে মেইন বিল্ডিং এর প্রভোস্ট স্যারের যে অফিস সে অফিস বরাবর দোতালায় নিয়ে গেল। দোতালায় নিয়ে যাওয়ার পর প্রথমে শরীফ ভাই আমাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেছিল আমিও উত্তর দিচ্ছিলাম। এমন সময় পাশের রুম থেকে রাহাত ভাই বের হয়ে আসলো। এসেই আমাকে জিজ্ঞেস করল তুই দাড়ি রেখেছিস কেন? আমি বললাম আমি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছি, আমার বাবা একজন আলেম......... আমার কথা শেষ হতে না হতেই উনি আমার মুখমণ্ডল জড়িয়ে প্রচন্ড রকম ভাবে কিল ঘুসি মারা শুরু করলেন। আর উনার আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেদেরকে বললেন যা ওকে ছাদে নিয়ে যা।
ছাদে নিয়ে যাওয়ার পরে আবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলো। আমি যেহেতু কিছুই জানিনা সে কারণে আমার না বলা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না। আমি যতই বলছি আমি কিছু জানি না। ওরা ততই নির্মমভাবে আমাকে মারা শুরু করল। ছাদের উপর রাখা পরিত্যক্ত কিছু টেবিলের পায়া ও কাঠ দিয়ে ওরা আমাকে মারা শুরু করল। আর এ সময়ে এই মারপিটে নেতৃত্ব দিচ্ছিল রিফাত ভাই। খুব সম্ভবত উনি একটা গ্রুপকে তখন আমার রুমে পাঠিয়ে দিয়েছেন সবকিছু চেক করার জন্য। মারপিট চলতে থাকে আর আমি চিৎকার করতে থাকি। এর মধ্যে পরিত্যাক্ত টেবিলের কাঠের সাথে যুক্ত হয় রড ও স্টিলের পাইপ। মারপিট চলতে থাকার একপর্যায়ে যারা রুমে গিয়ে তছনছ করে এসেছে তারা রিপোর্ট করলো, আমার রুমে আসিফ নজরুল স্যারের অনেকগুলো লেখা সংগ্রহ করা আছে এবং আমি একদিন ইবনে সিনা হসপিটালে ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। এই রিপোর্ট আসার পরে আরো জোরেশোরে মার শুরু হয়। বারবার জিজ্ঞেস করতে ছিল আমি কেন আসিফ নজরুল স্যারের লেখা সংগ্রহ করে রেখেছি? একজন বলল ও যে ইবনে সিনা থেকে ডাক্তার দেখিয়েছে সেখানেও ২৫ পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট পেয়েছে। তার মানে আমি ইবনে সিনা হসপিটাল থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়েছি। এই গাধাগুলো জানে না যে ইবনে সিনা হসপিটাল সবাইকেই ২৫% ডিসকাউন্ট দেয়। এটা সবার জন্য, কমন।
এরপরে ওরা রড দিয়ে আমার পায়ে আঘাত করতে থাকে যেন আমার পায়ের পাতা এবং হাড্ডি ভেঙ্গে যায়। আমি যে সু পরেছিলাম অধিকাংশ আঘাত সু এর উপর দিয়ে যাচ্ছিল। আঘাতে আঘাতে শরীরের বিভিন্ন জায়গা দিয়ে তখন ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। ওরা যখন দেখল অনেক মারের পরেও আমি কিছু জানি না বলে যাচ্ছি তখন ওরা আমাকে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। বেশ কয়েকবার ছাদের কার্নিশে নিয়ে যায় ফেলে দেবার জন্য। ছাদ থেকে যখন ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছিল তখন আমার চিৎকারে আশেপাশের অনেক ভাই জড়ো হয়ে গিয়েছিল হলের নিচে। যারা নিচ থেকে আমার চিৎকার শুনতেছিল। এসময়ে অনেকেই নিচ থেকে নিষেধ করেছে 'ফেলিস না' 'ফেলিস না' বলে। এর মধ্যে একজনের কথা স্পষ্ট মনে আছে, আরিফ জামান ভাই। উনি বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের জয়েন ডিরেক্টর হিসেবে আছেন, উনিও সেদিন অনেক জোরে ওদেরকে আমাকে যেন ছাদ থেকে না ফেলে দেয়া হয় সেই কথা বলেছিলেন।
ওরা যখন আমাকে ছাদ থেকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছিল ঠিক সেই মুহূর্তে ছাদের দরজায় অনেক আওয়াজ শুনতে পেলাম এবং এক পর্যায়ে খুব সম্ভবত তাদের দরজা ভেঙেই প্রভোস্ট স্যার এবং হলের কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা ছাদে চলে এসে এবং আমাকে এই হায়েনাদের হাত থেকে উদ্ধার করে নিচে নিয়ে যায়। তখন আমাদের হলের প্রভোস্ট ছিলেন ডক্টর আবু মুহাম্মদ দেলোয়ার স্যার। আমি হলের ডিবেট ক্লাব হাউস অফ ডিবেটারসের ছোটখাটো একটি দায়িত্ব পালন করতাম এবং বিভিন্ন সময় বিতর্কে অংশগ্রহণ করতাম। হলে থাকতে হলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় মাঝে মাঝে অংশগ্রহণ করতাম এবং দু একটি পুরস্কারও পেয়েছি। এ সকল কারণে স্যার আমাকে ব্যক্তিগতভাবে এবং আমাকে চেহারায় চিনতেন। স্যার ছাত্রলীগের কর্মীদেরকে বললেন, ও যদি কোন অপরাধ করে থাকে তাহলে সেটা পুলিশ দেখবে, আমি দেখব। স্যার আমাকে তার রুমে নিয়ে গেলেন, এবং তার চারপাশে তখন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ঘেরা। ইতোমধ্যে থানায় খবর দেওয়া হয়েছে থানা থেকে পুলিশ আসলো।
স্যার পুলিশকে সামনে রেখে ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের কাছে জিজ্ঞেস করলেন যে ওর কি অপরাধ? ছাত্রলীগ নেতারা বলল যে ও শিবির করে। স্যার বলল কিভাবে বুঝলে? ওরা কিছু বলতে পারল না। স্যার বলল ঠিক আছে তাহলে ওর মানিব্যাগ ও ওর মোবাইল চেক করে দেখা হোক। কিন্তু আমার মানিব্যাগ প্রথমে খুঁজে পাওয়া গেল না। মানিবাগে আমার ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা ছিল তখন। পরে ছাত্রলীগের কর্মীরা যারা আমাকে মেরেছিল ওরা মোবাইলটি স্যারের সামনে দিয়েছিল কিন্তু মানিব্যাগটি দিয়েছিল টাকা ছাড়া। তখন আমার মানিব্যাগ এবং মোবাইল তন্ন তন্ন করে খুজলো ওরা। কিন্তু কিছুই পেল না। তখন স্যার বলল ঠিক আছে আমি ওকে পুলিশের সপর্দ করে দিচ্ছি। পুলিশ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।শাহবাগ থানা থেকে যে পুলিশ এসেছিল উনি স্যার কে বললেন , স্যার ওকে নিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার আগে ওর চিকিৎসা অনেক বেশি জরুরী। ওতো আপনাদের ছাত্র, ওকে খুঁজে পাওয়া যাবে। ওকে যদি আগে হসপিটালে না পাঠান তাহলে ওর অবস্থা অনেক ক্রিটিকাল হয়ে যাবে। এরপরে স্যার হলের সিকবয়কে দিয়ে আমাকে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হসপিটালে পাঠালেন। হসপিটালে যাওয়ার পর বেশ কিছু ইনজেকশন দেওয়া হল আমার শরীরে, এবং প্রাথমিক চিকিৎসা চলছিল। সে সময়ে খবর পেয়ে আমার কিছু বন্ধুবান্ধব এবং ছোট ভাই বোন হসপিটালে উপস্থিত হয়েছিল। তখন আমার আইন বিভাগের বন্ধু আব্দুল আজিজ চলে এসেছিল আমাকে দেখতে। সবাই পরামর্শ দিল যে এই হসপিটালে থাকা আমার জন্য নিরাপদ না। ছাত্রলীগ যেহেতু আমাকে আয়েশ মিটিয়ে মারতে পারেনি সেহেতু ওরা আবার আসতে পারে এই হসপিটালে আমাকে মারতে। এবং ওরা বলল ঢাকা মেডিকেল কলেজেও আমার জন্য নিরাপদ নয়।
পরে আমার ডাক্তার বন্ধু রাশেদকে ফোন দিতে বললাম। ওরা আমার ফোন থেকে নাম্বার নিয়ে আমার বন্ধুর রাশেদকে ফোন দিল (বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেজর হিসেবে কর্মরত আছে ও)। ও তখন বরিশাল মেডিকেল এর ছাত্র, কিন্তু ওর বাসা ছিল আজিমপুরে এবং সৌভাগ্যবশত ও তখন ঢাকায় ছিল। ও জানার সাথে সাথে চলে আসলো এবং আমাকে হসপিটাল থেকে নিয়ে গেল এবং নানা কৌশলে আমাকে বরিশালে পাঠানোর ব্যবস্থা করলো।
তখন সারাদেশে কঠোর হরতাল চলছে। একমাত্র নৌ যোগাযোগ ব্যতীত অন্য সকল যোগাযোগই বন্ধ ছিল তখন। রাশেদ আমাকে এই অবস্থায় বরিশাল পাঠাতে চাচ্ছিলনা। কিন্তু আমি জোর করলাম এবং ওকে বললাম যেহেতু এই অবস্থায় কেউ ঢাকা আসতে পারবেনা এবং ঢাকার বাইরে বের হবার একমাত্র পথ নৌপথ সেহেতু আমাকে বরিশাল পৌঁছাতে পারলে আব্বা-আম্মা ও আপনজনদেরকে কাছে পাবো।আমাকে বরিশাল লঞ্চ ঘাটে থেকে নিতে এসেছিলেন আমার খালা। তখন এতই কঠোর হরতাল পালন হচ্ছিল যে উনি একটি সবজি পরিবহন করে এমন একটি ভ্যানে করে এসেছিলেন আমাকে নিতে এবং বড় একটি ওড়না দিয়ে আমার সমস্ত শরীর ঢেকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। ঢাকার হসপিটাল থেকে রাশেদের বাসা, সেখান থেকে লঞ্চঘাট হয়ে বরিশাল, সেখান থেকে খালার বাসা হয়ে আবার হসপিটাল যাতায়াতের এই সময়টিতে আমাদের প্রচণ্ড সতর্কতার সাথে চলতে হয়েছে। কারণ আর দু-তিন দিন আগেই মওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় হয়েছিল এবং সেই রায়ের বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নেমে আসলে পুলিশ তাদের উপর গণহত্যা চালায়, চলে গণ গ্রেপ্তার। আশঙ্কা ছিল লোকজন সন্দিহান হয়ে নানা প্রশ্ন করবে বা পুলিশ আমার এ অবস্থা দেখলে নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসাবাদ করবে এবং এক পুলিশের হাত থেকে আটক এড়াতে পারলেও অন্য কোন নির্মমতা, লীগের অন্য কোন পেটোয়া বাহিনীর নির্যাতন বা অন্য পুলিশের হাতে আটকের সম্ভাবনা কম ছিলনা তখন।
আহত অবস্থায় আব্বা-আম্মার সাথে কথা বললেও তাদেরকে বুঝতে দেইনি প্রথমদিকে। হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর আব্বা-আম্মাকে জানানো হলো। আম্মা বরিশালে আসলেন একদিন পরে অনেক কষ্ট করে। মোরেলগঞ্জ থেকে বরিশাল ভ্যান রিক্সা করে ভেঙে ভেঙ্গে অসংখ্যবার যানবহন চেঞ্জ করে। একটু সুস্থ হবার পরে বরিশাল থেকে আম্মা নিয়ে গেলো বড় খালার বাসায়, বেকুটিয়ায়। সেখানে কিছুদিন থাকার পরে গেলাম খুলনায়, আপার বাসায়। প্রায় মাস খানেক সেখানে থেকে চিকিৎসা নিয়েছিলাম।সমস্ত শরীরের নির্যাতনের কারণে শরীর ফুলে প্রায় দ্বিগুণ/তিন গুণ হয়ে গিয়েছিল আমার। সাপোর্ট নিয়ে এক পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়েছে মাসের পর মাস। দীর্ঘ মেয়েদের শরীরে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। আর মানসিক আতঙ্ক তো আছেই। এখনো ঘুমের ঘোরে ভয়ে কেঁপে উঠি।বিভিন্ন সময়ে আমার বন্ধুদের সেই সময়ের সমাবর্তনের ছবিগুলো মাঝে মাঝে ফেসবুকে সামনে চলে আসে। আমার বন্ধুরা হয়তো তাদের সে সময়ের মধুর স্মৃতি রোমন্থন করে আর আমি সেই ছবি দেখে ২০১৩ সালের সেই অতীতে ফিরে যাই আর আতঙ্কে কেঁপে উঠি।
-
মুহাম্মদ আরিফুর রহমান
এডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট অফ বাংলাদেশ
কুয়ালা লামপুর, মালয়েশিয়া
১৪.০৩.২০২৫
পুনশ্চ: আমার উপরে করা ছাত্রলীগের নির্যাতনের ঘটনা পুরোপুরি তুলে ধরতে অনেকেই অনুরোধ করেছিলেন। চেষ্টা করেছি শতভাগ সত্য বিবরণী লিখে রাখতে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে ছাত্রলীগ কত নির্মম, বর্বর আর অসভ্য ছিল। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি কতটা ভয়ংকর হতে পারে সেটা জেনে ভবিষ্যতের নেতারাও সিদ্ধান্ত নিতে পারবে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি থাকবে কিনা!