Image description
 

আরে মিয়া থামেন থামেন, আগে কথা শোনেন। দলের বাহাদুরি আমাকে দেখাবেন না। দলের যে মালিক সেই পরিবারের বড় আত্মীয় আমি। রেস্তা সম্পর্ক কিছুই জানেন না, এখন শুনে রাখেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে শ্রদ্ধার বড় বোন ছিলেন মরহুমা ফাতেমা বেগম। তারই আদরের নাতি হলো আমার মেয়ে-জামাতা। সে হিসেবে শেখ হাসিনা আমার বেয়াইন। ’

 

বিক্ষুব্ধ ঠিকাদারদের হৈ-চৈ দুই হাতে থামিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বহুল আলোচিত ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান। বিগত ১৫ বছরে ব্যাপক দুর্নীতির কারণে তাকে ‘দুর্নীতির বরপুত্র’ও বলা হয়।

 

সূত্র জানিয়েছে, ওয়াসার বড় বড় প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি জানার পরও শেখ হাসিনা বরাবরই শুধু নীরবই থাকেননি, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত দফায় দফায় এমডি পদে তার মেয়াদ বাড়ান সাতবার। সর্বশেষ ২০২৩ আগস্টে সপ্তম বারের মতো ওই পদে আরও তিন বছরের জন্য নিয়োগ পেয়েছিলেন তাকসিম এ খান। ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলেও তাকসিম দেশ ছাড়তে পারেননি। ভঙ্গুর ও ঋণগ্রস্ত ওয়াসাকে ফেলে অনলাইনে পদত্যাগ করে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান তিনি। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে গোপন তৎপরতার অভিযোগ উঠেছে।

 

ওয়াসার সাবেক এই এমডির বিরুদ্ধে অর্থ পাচার, নিয়োগ-বাণিজ্য, বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অন্যান্য খাতে অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে তাকসিম এ খানসহ বোর্ডের ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি দুদকের উপ-পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি করেন।

 

মামলায় বলা হয়, ওয়াসার সাবেক পরিচালক আবুল কাশেম ও এ কে এম সহিদ উদ্দিনের নিয়োগ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেন আসামিরা। পাশাপাশি তাদের বেতন-ভাতা বাবদ উত্তোলিত ১ কোটি ৯৮ লাখ ৬৫ হাজার ৯৮০ টাকা আত্মসাতের সহযোগিতা করেন। আবুল কাশেম অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যক্তিস্বার্থে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য পরস্পর যোগসাজশে অনিয়ম–দুর্নীতির মাধ্যমে পরিচালক (উন্নয়ন) পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে বেতন-ভাতাদি বাবদ ৯৯ লাখ ৫২ হাজার ২৭১ টাকা উত্তোলনপূর্বক আত্মসাৎ করেন। অন্যদিকে এ কে এম সহিদ উদ্দিনও বেতন-ভাতাদি বাবদ ৯৯ লাখ ৫২ হাজার ২৭১ টাকা উত্তোলনপূর্বক আত্মসাৎ করেন।

দুদক সূত্রের দাবি, মামলা দায়েরের পর একদফা তদন্ত দল পরিবর্তন হলেও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।

 

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের উপ-পরিচালক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ পাওয়া গেছে। এগুলো তদন্তে একটু সময় লাগতে পারে। তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চলছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, দুর্নীতিবাজদের সেই চেষ্টা থাকতেই পারে। এরপরও এ সময়ে অভিযোগের তদন্ত হবে সঠিকভাবেই বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

 

এছাড়া রাজধানীর মুগদায় আবদুল বাছেদ শামীম নামে এক আইনজীবীকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাকসিম এ খানসহ ৫৯ জনের নামে মামলা হয়েছে।

 

এদিকে ঢাকা ওয়াসা কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতারা সরকারকে লেখা এক চিঠিতে অভিযোগ করেন, পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনগার প্রকল্পের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে ৬০০ কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে, এছাড়া দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৬০০ কোটি টাকা, পানি ও পয়ঃবিলের ৩ হাজার ২২১ কোটি টাকা, ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের ৬২১ কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে। তাদের অভিযোগ, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিতাড়িত শেখ হাসিনার আত্মীয় বলে তিনি আইনের তোয়াক্কা না করে যা খুশি তাই করেছেন। অন্যায়ভাবে অনেককে চাকরিচ্যুত করেছেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও অনেককে স্বাভাবিক কার্যক্রম করতে দেননি।

 

সংশ্লিষ্টরা জানান, তাকসিম এ খান এতই ক্ষমতাধর ছিলেন যে, দেশের কোনো আইন ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা তার কিছুই করতে পারেনি। অভিযোগের পর অভিযোগ প্রমাণিত হলেও শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রশ্রয়ে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ওয়াসাকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেন। বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও প্রকল্পের নামে লুটপাট করেছেন ১৫ হাজার কোটি টাকা। নিজে এবং বিগত সরকারের দোসরদের সঙ্গে মিলেমিশে লুটপাট চালিয়েছেন। তার মেয়াদে শত শত কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু নগরবাসী এসব প্রকল্প থেকে সুবিধা পাননি। উল্টো পানি ও পয়ঃসেবার দাম বাড়িয়ে রাজধানীবাসীকে দুর্ভোগে ফেলেছেন। ২০০৯ সালের পর থেকে ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বাড়ান ১৬ বার।

 

অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ঢাকা ওয়াসাকে তিনি রুগ্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। বৈদেশিক সহায়তা নির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়নে এই সংস্থাটি প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ঢাকা ওয়াসার এমডি হিসেবে তাকসিমের মাসিক বেতন ছিল ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। সর্বশেষ করোনা মহামারির মধ্যে একলাফে ওয়াসার এমডির বেতন বাড়ানো হয় পৌনে দুই লাখ টাকা।

 

আত্মগোপনে তাকসিম, গ্রেপ্তারে তৎপরতা নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর

 

ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পলায়নের পর থেকেই খোঁজ ছিল না তাকসিমের। এরপর এক দিনও নিজের দপ্তরে আসেননি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী। যে কোনো সময় দেশ ত্যাগ করতে পারেন তিনি। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা মাথায় নিয়েই দেশে আত্মগোপনে রয়েছেন তাকসিম। নানা উপায়ে বিদেশে পালাতে চেষ্টা করছেন তিনি। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নিয়মিত ক্লিনসেভ করা তাকসিম মুখে দাড়ি রেখেছেন। নিজের বেশভূষায় পরিবর্তন করে ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করছেন। প্রথমে ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলের প্রেসিডিয়াম স্যুটে বিলাসি জীবনযাপন করলেও বর্তমানে কোথায় রয়েছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

 

এদিকে সরকারের একাধিক সংস্থা কাগজে-কলমে তাকসিমের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা ও তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর কথা বলেই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। নিষেধাজ্ঞার পরও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন তিনি। তাকে গ্রেপ্তারের দায়িত্ব পাওয়া সংস্থাগুলোর কার্যকর তৎপরতা নেই।

 

সূত্রটি বলছে, ওয়াসার এমডি থাকাকালে ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরটি বন্ধ রেখেছেন তাকসিম। তবে লন্ডনের একটি মোবাইল নম্বর রোমিং সুবিধা নিয়ে ব্যবহার করছেন। মূলত হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাপ দিয়ে দেশের বাইরে শেখ হাসিনাসহ অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। নির্ভরযোগ্যে একটি সূত্রের দাবি, বর্তমানে বিশেষ একটি প্রভাবশালী বাহিনীর এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার আশ্রয়ে আছেন তাকসিম এ খান। সুযোগ পেলেই তাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে। সূত্রটি বলছে, সম্প্রতি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের যে সব ঝটিকা মিছিল হয়েছে তার পেছনে তাকসিম এ খানের হাত রয়েছে। এসব প্রোগ্রামে বিপুল অর্থের যোগান দিচ্ছেন তিনি।

 

যুক্তরাষ্ট্রেরও নাগরিক তাকসিম ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালে ঢাকা ওয়াসার এমডি হিসেবে যোগ দেন। তার পরিবারের সব সদস্য যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। তাকসিমের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

 

যুক্তরাষ্ট্রের ১৪ বাড়ির মধ্যে পাঁচটির তথ্য

সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে তাকসিম এ খানের বিভিন্ন শহরে ১৪ বাড়ি রয়েছে যার মধ্যে পাঁচটির তথ্য মিলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে পরিবার-পরিজন নিয়ে তাকসিম যে বাড়িতে থাকেন, সেটার ঠিকানা- ৫৩১, এন লুইস সেন্ট. ইউনিট ৩০২ গ্লেনডেল, সিএ ৯১২০৬। এ ছাড়া ৪১৯, ই সাইপ্রেস অ্যাভিনিউ বারব্যাংক, সিএ ৯১৫০১ এ ঠিকানায় ২০১৭ সালে ১৯ লাখ ৭৬ হাজার ৮৮৯ ডলারে (সে সময়ের দরে আনুমানিক ১৭ কোটি টাকা) কেনা বাড়িটিতে রয়েছে ১৪টি বেডরুম ও ১৪টি বাথরুম। ৫১৮, সেলেম স্ট্রিট গ্লেনডেল, সিএ ৯১২০৩- এই ঠিকানায় ২০১৮ সালের আগস্টে ৪৩ লাখ ৯৮ হাজার ৪৭৪ ডলারে (আনুমানিক ৩৭ কোটি টাকা) কেনা বাড়িটিতে রয়েছে ছয়টি বেডরুম ও ছয়টি বাথরুম। ৩৫০ ই ৩০তম স্ট্রিট নিউইয়র্ক, সিএ ১০০১৬-৮৩৮৬- এই ঠিকানায় ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ৬ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৬১৪ ডলারে (আনুমানিক ৫৩৫ কোটি টাকা) কেনা বাড়িটিতে রয়েছে ১০২টি বেডরুম ও ১০২টি বাথরুম।

 

৩৫৫৫ কাইসস্টোন অ্যাভিনিউ লস অ্যাঞ্জেলস, সিএ ৯০০৩৪- এই ঠিকানায় ২০১৯ সালের অক্টোবরে ৮২ লাখ ৭৫ হাজার ৯৮০ ডলারে (আনুমানিক ৭০ কোটি টাকা) কেনা বাড়িটিতে রয়েছে ১২টি বেডরুম ও ১২টি বাথরুম। বাড়িগুলো তাকসিম ভাড়া দিয়ে রেখেছেন।

 

যুক্তরাষ্ট্রে তাকসিমের বাড়ি-গাড়িসহ অঢেল সম্পদ থাকলেও দেশে তার কোনো সম্পত্তি নেই। গুলশান-২ এর ৫৫ নম্বর সড়কে সরকারি বাসভবনে তিনি বসবাস করতেন না। তিনি নয়াপল্টনে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন।

 

সার্বিক বিষয়ে ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে বার্তা পাঠালেও কোনো প্রতি উত্তর পাওয়া যায়নি।