
অনিয়ম যেন পিছু ছাড়ছে না ঢাকা ওয়াসার গন্ধবপুর পানি শোধনাগার প্রকল্পে। কমবেশি ৩ হাজার ৯৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পের কাজ এখনো চলমান।
মূল প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৩ কিলোমিটার পানি সরবরাহের পাইপ কিনে বসানো হয়েছিল আগেই। এই পাইপ কেনাকাটায় উঠেছে অনিয়মের অভিযোগ। চীনের একটি আদালতে সংশ্লিষ্টদের মোটা অঙ্কের ঘুষ দেওয়ার কথা স্বীকারও করেছে পাইপ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। এবার খালের তলদেশে বসানো এসব নিম্নমানের পাইপ কিছুটা পরিবর্তনের নামে আরও দেড় শ কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। এক কিলোমিটার পাইপ পরিবর্তন করতে উঠেপড়ে লেগেছেন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এ জন্য টাকা চেয়ে চিঠিও দেওয়া হয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগে।
জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফজলুল রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘গন্ধবপুর পানি শোধনাগার প্রকল্পে পাইপ পরিবর্তন বা পন্ড ক্রসিংয়ের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সুপারিশে পিডি ৮০ কোটি টাকার মতো চেয়েছেন। এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি এখনো। তবে একটুকু বলতে পারি, আমি এখানে কোনো টাকা দিতে পারব না, তা জানিয়ে দিয়েছি। যদি প্রকল্পের টাকা থেকে কাজ করতে পারে, তাহলে করুক।’
ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, ঢাকা ওয়াসার ‘পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও গণমুখী পানি ব্যবস্থাপনা’ প্রকল্পের যে অংশে এক কিলোমিটার পাইপ পরিবর্তন করার কথা বলা হচ্ছে, সেটি প্যাকেজ-১-এর আরডব্লিউপি অংশের আওতায় আছে। বর্তমানে খালের এই অংশে বসানো হয়েছে ‘ডাকটাইল আয়রন’ পাইপ। তা পরিবর্তন করে সেখানে ‘কার্বন স্টিল’ পাইপ বসানো হচ্ছে। এই পাইপ পরিবর্তনে ৮ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার ব্যয় বৃদ্ধির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান একটি প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাব প্রকল্প পরিচালকের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার বিভাগে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়।
এ নিয়ে ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একটি প্রকল্পে পাইপ বসানো হয়েছে মোট ২৩ কিলোমিটার। সেখানে মাঝপথ থেকে এক কিলোমিটার পরিবর্তন করা হচ্ছে। যে অংশটুকু পাইপ পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে, তা খালের অংশ। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার আগেই এই পাইপ কীভাবে ‘ড্যামেজ’ বা খারাপ হলো, সেই বিষয়ে আগে তদন্ত হওয়া দরকার।
জানতে চাইলে দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গতকাল বুধবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এটা কারও মামার বাড়ির আবদার না। জনগণের অর্থে পরিচালিত প্রকল্প, জনস্বার্থে বাস্তবায়িত হবে। কারও খেয়ালখুশিমতো বরাদ্দ চাইবে, সেটা তো হতে পারে না।’
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী পুরো ২৩ কিলোমিটার পাইপের চুক্তি মোতাবেক গুণগত মান নিশ্চিত সাপেক্ষে সরবরাহকারী মূল অনুমোদিত মূল্য প্রাপ্য হবে। এমনকি যদি যথানিয়মে চুক্তি সম্পাদিত হয়ে থাকে, তবে সরবরাহ পরবর্তী নির্ধারিত মেয়াদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণের দায়ও সরবরাহকারীর। অতএব ডেলিভারির আগে কোনো যুক্তিতেই অতিরিক্ত বরাদ্দ যৌক্তিক হতে পারে না। যদি কোনো কারণে স্থাপিত পাইপ পরিবর্তন করতে হয়, তার ব্যয় সরবরাহকারীকে বহন করতে হবে। এর দায় সরকার গ্রহণ করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত খরচের জন্য নতুন কোনো বরাদ্দের প্রস্তাব সরকার অনুমোদন দিলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’
ওয়াসার কর্মকর্তারা জানান, ওয়াসার এই বিশাল বাজেটের প্রকল্পকে তিনটি প্যাকেজে ভাগ করে সংস্থাটি। এগুলোর মধ্যে একটি প্যাকেজের দরপত্রের মূল্য ৩ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। সেখানে রয়েছে পানি সরবরাহের জন্য পাইপ কেনাকাটা। আর এই অংশে শুরুতেই অনিয়ম হয়েছে। চুক্তি করা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পানির পাইপ কেনার পরিবর্তে অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান থেকে নিম্নমানের পাইপ কেনা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সংক্ষুব্ধ চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আদালতে অভিযোগ দিলে তা প্রমাণিত হয়।
কর্মকর্তাদের দাবি, প্রকল্পটিতে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে ‘সুয়েজ অ্যান্ড এটিভি ভেনেওলিয়া’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। ১ হাজার ৬০০ মিলিমিটার ব্যাসের মোট ২৩ কিলোমিটার পাইপ বসানোর জন্য ‘সুয়েজ অ্যান্ড এটিভি ভেনেওলিয়া’ নামের প্রতিষ্ঠানটি ফ্রান্সের সেন্ট গোবিন, জাপানের কুবোট এবং চীনের শিংশিং নামের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। নিয়ম অনুযায়ী তিনটি প্রতিষ্ঠানের যেকোনো একটি থেকে পাইপ নিতে পারবে ঠিকাদার। পরে চীনের শিংশিং-এর কাছ থেকে অর্ধেক পাইপ নিয়ে বাকি অর্ধেক পাইপ কম দামে শ্যানডং গুয়োমিং নামের প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া হয়। বিষয়টি জানতে পেরে শিংশিং নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনের আদালতে অভিযোগ দেয়।
এরপর শ্যানডং গুয়োমিং চীনের আদালতকে জানায়, তারা এ কাজটি পেতে সংশ্লিষ্টদের কমবেশি ৬৫ কোটি টাকা দিয়েছে। তবে এই ‘৬৫ কোটি টাকা’ সার্ভিস চার্জ নামে উল্লেখ করেন। যদিও প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) এ ধরনের সার্ভিস চার্জ নামে কিছু নেই।এসব বিষয়ে জানতে প্রকল্প পরিচালক ওয়াহিদুল ইসলাম মুরাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিস্তারিত শুনে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।