
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক ও টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক প্রধান জিয়াউল আহসানের কথায় চলত পতিত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনেক কাজ। তাঁদের কাজে বাধা দেওয়ায় তখনকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সচিবকে পরিবর্তন করার তথ্যও পাওয়া গেছে।
আইজিপি শহীদুল হক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গড়ে তুলেছিলেন নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন বাণিজ্যের সিন্ডিকেট। সেই সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের পিএস হারুন অর রশীদ বিশ্বাস।
দীর্ঘদিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উপসচিব পদে দায়িত্ব পালনকারী এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, ২০১৭ সালে আইজিপি ছিলেন এ কে এম শহীদুল হক। আর এনটিএমসির প্রধান ছিলেন জিয়াউল আহসান। একই সময়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের পিএস ছিলেন হারুন অর রশীদ বিশ্বাস। আর র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন বেনজীর আহমেদ।
ইসরায়েলি আড়ি পাতার যন্ত্র কেনার বিষয়ে ২০২২ সালের শেষের দিকে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেেজর এক রিপোর্টে বলা হয়, সাইপ্রাসে নিবন্ধিত ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশের এনটিএমসি নজরদারি প্রযুক্তি কিনেছে। ওই সময় দেশের একটি ইংরেজি দৈনিক হারেেজর খবরের সূত্রের বরাতে জানায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে অন্যান্য উপকরণের পাশাপাশি ১৯১ কোটি টাকা খরচ করে ‘ভেহিকল মাউন্টেড ডেটা ইন্টারসেপ্টার-২’ কেনার কথা উল্লেখ আছে। এ নিয়ে তখন দেশে ব্যাপক আলোচনা হয়। ওই সময় জিয়াউল আহসান গণমাধ্যমের কাছে ইসরায়েল থেকে আড়ি পাতার যন্ত্র কেনার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
ইসরায়েলি আড়ি পাতার যন্ত্র কেনার বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব গত সোমবার নিজের দপ্তরে কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁরা এনটিএমসির কাছে তথ্য চেয়েছেন। তবে এখনো পাননি।
আবার একই সময়ে ধরা পড়ে পুলিশে নিয়োগ বাণিজ্যের চিত্র। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের পিএস হরুন অর রশীদ বিশ্বাস ও আইজিপি শহীদুল মিলে প্রতি নিয়োগে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে ঘুষ বাণিজ্য করেন। ওই তথ্য পেয়ে যান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার এক কর্মকর্তা। বিষয়টি তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নজরে আনেন। ওই কর্মকর্তা সম্প্রতি কালের কণ্ঠকে জানান, তিনি যখন হারুনের নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নজরে আনেন, তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চমকে বলে ওঠেন, ‘কী বলছেন হারুন! না, এটা হতে পারে না।’
ওই কর্মকর্তা আরো জানান, দুঃখের বিষয় হলো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবাক হলেন, মনে করলেন হারুন ঘুষ নিতেই পারেন না। অথচ শেষ পর্যন্ত হারুনের দেওয়া তালিকা ধরেই নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ভাগ পেয়েছেন, তা তো বোঝাই যায়।
তিনি জানান, হারুনের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ এলেও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তাঁকে পদোন্নতি দিয়েছেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে হারুন উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব, এরপর অতিরিক্ত সচিব হওয়ার সুযোগ পান।
তিনি আরো জানান, ওই সময় হারুনের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনে জানানো হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও ম্যানেজ করেছিলেন হারুন। হারুনকে ছায়া দিতেন শহীদুল ও জিয়াউল আহসান। ফলে নিয়োগ বাণিজ্যে শত কোটি টাকার দুর্নীতি করলেও তাঁর কোনো সমস্যা হয়নি।
চক্রটি পুলিশের এসপি, ডিআইজি এবং কমিশনার পদে বদলিতেও বিপুল টাকার বাণিজ্য করেছে। পাশাপাশি কারাগারের জেল সুপার ও জেলারদের নিয়োগ, বদলিতেও ছিল তাঁদের হাত। এমনকি হারুন অর রশীদ বিশ্বাস সমবায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হয়ে চলে যাওয়ার পরও পুলিশে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে ভূমিকা রাখতেন। জানা গেছে, প্রতিদিন সন্ধ্যার পর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে দেনদরবার করে ঘুষের অঙ্ক ঠিক করতেন তিনি।
সূত্র জানায়, আইজি শহীদুল ও জিয়াউলের প্রস্তাব আটকে দেওয়ার পর তখনকার স্বরাষ্ট্রসচিব ড. কামাল উদ্দিন আহমেদকে সরিয়ে দিয়ে তাঁদের অনুগত মোস্তাফা কামাল উদ্দিনকে ওই পদে বসানো হয়। এরপর পুলিশ ও এনটিএমসির কেনাকাটায় আর কোনো বাধা তৈরি হয়নি। পুলিশ ও এনটিএমসিকে ‘খুশি’ রেখে পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিনি। মোস্তাফা কামাল উদ্দিনকে সিনিয়র সচিব হিসেবেও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত বছর গণ-অভ্যুত্থানের পর রেহাই পাননি মোস্তাফা কামাল উদ্দিন। যুবদল নেতা শামীম মোল্লা হত্যা মামলার আসামি হিসেবে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদও করে পুলিশ। একই চিত্র আইজিপি শহীদুল হক ও জিয়াউল আহসানের। তবে হারুন অর রশীদ বিশ্বাস কোথায় আছেন, তা নিশ্চিত করতে পারেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো সূত্র।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেখুন এসব বিষয় নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না।’
কানাডায় বাড়ি : এদিকে আইজিপি শহীদুল হকের শত কোটি টাকার সম্পদের দলিলসহ বিভিন্ন নথি খুঁজে পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাঁর এক আত্মীয়ের বাসায় অভিযান চালিয়ে নথিগুলো জব্দ করা হয়। ওই সব নথির মধ্যে জার্মানির বন শহরে থাকা বাড়ির মূল দলিল এবং কানাডার টরন্টোতে থাকা আরেকটি বাড়ির মূল দলিল পাওয়া গেছে। দুদক কর্মকর্তাদের দাবি, জব্দ হওয়া নথিপত্রে কোটি কোটি টাকার সম্পদের তথ্য রয়েছে। শহীদুল হক তাঁর সম্পদের গুরুত্বপূর্ণ নথিগুলো আত্মীয়ের মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরিয়ে গোপন করার চেষ্টা করেছিলেন।