Image description
মানিকগঞ্জের মহীউদ্দীনের আয়ের উৎস অজানা

মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম মহীউদ্দীন। ‘আইনজীবী পেশা’ ছাড়া বৈধ আয়ের অন্য কোনো উৎস নেই তার। এর পরও কয়েক বছরেই গড়েছেন বিপুল অবৈধ সম্পদ। ছেলেমেয়ে, মেয়ের জামাইসহ পরিবারের সদস্যদের নামে ব্যাংক হিসাব খুলে লেনদেন করেছেন কয়েকশ কোটি টাকা। ঘুসের টাকাও নিয়েছেন এসব অ্যাকাউন্টে। অবৈধ এসব অর্থ দিয়ে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নামে কিনেছেন জমি, বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গোলাম মহীউদ্দীন ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে করা ১২টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে শতকোটির বেশি (১০৮ কোটি) টাকা লেনদেন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা জমা এবং ৪৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এসব ব্যাংক হিসাবে স্থিতি রয়েছে ৩৩ লাখ টাকা। তার নিজের এবং ছেলে ও মেয়ের নামে পরিচালিত এসব ব্যাংক হিসাবে ৫৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা জমা হলেও এর বৈধ আয়ের উৎস পাওয়া যায়নি। ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের মাধ্যমে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ইজদিয়া ও ভবানীপুর ইউনিয়নে ৭৭০ শতাংশ জমিও কিনেছেন। ২০১৬ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মাত্র ছয় বছরে এসব জমি কিনেছেন তিনি।

জমির মালিকানা দিয়ে গড়ে তুলেছেন আরএন অ্যাগ্রো নামের খামার। এ ছাড়া ৭৭০ শতাংশ জমি মর্টগেজ দিয়ে এক্সিম ব্যাংকের মানিকগঞ্জ শাখা থেকে গত বছরের অক্টোবর ও ডিসেম্বরে তার তিনটি ব্যাংক হিসাবে ৭৫ লাখ টাকা ঋণ মঞ্জুর হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঋণ হিসাবের দলিলাদিতে খামারের কথা উল্লেখ করা হলেও অ্যাগ্রো ফার্মটিতে দৃশ্যমান কোনো উৎপাদনশীল কার্যক্রম নেই। প্রকৃতপক্ষে তিনি অজ্ঞাত উৎস থেকে অর্জিত অর্থ দিয়ে কেনা জমি বন্ধক রেখে উল্লিখিত সম্পদ বৈধ করার চেষ্টা করেছেন।

এদিকে অবৈধ আয়ের টাকায় কেনা জমির রেজিস্ট্রি করার সময়ও জালিয়াতির মাধ্যমে জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে কর ফাঁকিও দিয়েছেন আওয়ামী লীগের এই নেতা। শাহানা মতিন নামের একজনের কাছ থেকে ২ দশমিক ৮৩৫ শতাংশ জমি কেনার সময় ভিটি বাড়ি জমি নাল জমি দেখিয়ে মাত্র দুই লাখ টাকায় রেজিস্ট্রি দলিল করা হয়। এই জমি নিজের ও ছেলে শাহ নেওয়াজ মহীউদ্দীনের নামে কিনেছেন তিনি।

এ ছাড়া মানিকগঞ্জ জেলা শহরে দুটি বহুতল ভবন করেছেন গোলাম মহীউদ্দীন। নিজের ও ছেলের নামে রয়েছে একাধিক গাড়ি। বৈধ আয়বহির্ভূত এসব অর্থ দিয়ে সান লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির শেয়ার কিনে বাগিয়েছেন পরিচালক পদ। মেয়ের নামে ঢাকার মিরপুরে অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। নিজের নামে রাজধানীর বসুন্ধরায় অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। শুধু তাই নয়, সংঘবদ্ধভাবে মানিকগঞ্জ জেলায় বৈধ-অবৈধভাবে জমি দখল ও ভবন নির্মাণের প্রমাণও পেয়েছে বিএফআইইউ।

নিজের অন্যায় অপকর্মে ছেলে-মেয়েদের জড়িয়েছেন এই আওয়ামী লীগ নেতা। তাদের বৈধ আয়ের কোনো উৎস না থাকলেও ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। মেয়ে নাজমুন নাহার মুনমুনের নামে পরিচালিত সঞ্চয়ী ব্যাংক হিসাবে ২০১৩ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বড় অঙ্কের ২২টি নগদ জমার মাধ্যমে এক কোটি ৭৬ লাখ টাকা সিটি ব্যাংক মানিকগঞ্জ শাখায় জমা হয়। গোলাম মহীউদ্দীন এবং মুনমুনের স্বামী হাফিজুর রহমান চেকের মাধ্যমে ওই টাকার এক কোটি পাঁচ লাখ তুলে নেন। এ ছাড়া এই হিসাবটি থেকে একটি বড় অঙ্কের চেকের মাধ্যমে ৫৪ লাখ টাকা জমা এবং বিভিন্ন হিসাবে ৮৫ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে।

মুনমুনের নামে পরিচালিত হিসাবে ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর মেসার্স আদিল এন্টারপ্রাইজের ব্যাংক হিসাব থেকে ২৭ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. মাসুদ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঢাকা আঞ্চলিক হিসাব কেন্দ্রের নামে জনতা ব্যাংকের দিলকুশা শাখায় পরিচালিত হিসাব থেকে একই বছরে ৭ এপ্রিল আদিল এন্টারপ্রাইজের অ্যাকাউন্টে ৭৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়। কাজের টাকার ঘুস হিসাবে মুনমুনের হিসাবে দেওয়া হয় ওই ২৭ লাখ টাকা।

অবৈধ উৎস হতে সম্পদ অর্জনের জন্য ঋণ হিসাবকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছেন গোলাম মহীউদ্দীন। ব্যাংক থেকে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে কয়েক কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এ টাকায় নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে কিনেছেন জমি, ফ্ল্যাট, গাড়ি ও আসবাবপত্র। অন্যদিকে বৈধ আয়ের কোনো উৎস না থাকলেও এসব ঋণ শোধ করেছেন নিজের এবং ছেলে ও মেয়ের নামে পরিচালিত বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব থেকে। এ অন্যায় কাজে যুক্ত করেছেন জামাই (মুনমুনের স্বামী) মোহাম্মদ হাফিজুল ইসলামকেও।

এদিকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন দাখিল করা আয়কর বিবরণীতে গোলাম মহীউদ্দীন তার অর্জিত মোট সম্পদের পরিমাণ দেখিয়েছেন তিন কোটি ৭০ লাখ টাকা। সেখানে তার নামে কেনা ৭ দশমিক ৭০ একর জমির বিপরীতে ৪ দশমিক ৭৪ একর কৃষি জমি অর্জনের বিষয়টি উল্লেখ করেন। এছাড়া দুটি আবাসিক ভবনের ১/৪ ভাগ এবং ১/২ ভাগ মালিকানা দেখালেও প্রকৃতপক্ষে ভবন দুটি অর্জনের সব অর্থ তিনি সরবরাহ করেছেন।

বর্তমানে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতিতে যুক্ত হন গোলাম মহীউদ্দীন। ১৯৭৭ সালে মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এবং ১৯৮০ সালে প্রচার সম্পাদক হন। ১৯৮৪ সাল থেকে তিনি ২০০৩ সাল পর্যন্ত মোট ১৯ বছর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলেন। ২০০৩ সাল থেকে মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালে এবং ২০২২ সালে তিনি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

পেশা হিসাবে আইনজীবী উল্লেখ করলেও আওয়ামী লীগের পদ-পদবি ব্যবহার করে অন্যায়-অপকর্মের মাধ্যমে শতকোটি টাকার মালিক হন গোলাম মহীউদ্দীন। বিশেষ করে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে এই অঢেল সম্পদ করেন তিনি। যদিও ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই আত্মগোপনে রয়েছেন তিনি। তার নামে বেশ কয়েকটি মামলাও হয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে নানা মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।