Image description

বাংলাদেশে তখন একতরফা নির্বাচনের আয়োজন চলছিল। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ওই নির্বাচনের আগে ৪ জানুয়ারি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চলছিল সাপ্তাহিক ব্রিফিং।

বক্তব্য রাখছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল। বিএনপি, জামায়াতসহ অনেক দলের বর্জন সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের ওই নির্বাচন আয়োজন নিয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়, প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না, এ বিষয়ে ভারতের অবস্থান কী? তখন জয়সওয়াল বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত বলে আসছি, বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের জনগণ তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। ’

এরপর এলো জুলাই। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে দেশের রাজপথ তখন উত্তাল। হাসিনার নির্দেশে তার দল আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডার এবং পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবিসহ নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে রাজপথে ঝরছিল শত শত প্রাণ। এই পরিস্থিতির মধ্যে ২৫ জুলাই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চলছিল সাপ্তাহিক ব্রিফিং। সেখানে বক্তব্য রাখছিলেন জয়সওয়াল। যথারীতি তাকে বাংলাদেশের আন্দোলন পরিস্থিতি ঘিরে ভারতের অবস্থানের বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। তখন ভারত সরকারের এ মুখপাত্র বলেন, ‘বাংলাদেশের ঘটনাবলীর দিকে ভারত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছে। তবে সেখানে যা চলছে, তা সম্পূর্ণভাবে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ’

বাংলাদেশের রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের ‘প্রভাবের’ কথা সচেতন মহলের জানা। ওয়ান-ইলেভেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনসহ অতীতে তাদের এই প্রভাবের বিষয়টি মাথায় নিয়ে স্বভাবতই গত জানুয়ারি ও জুলাইয়ের ওই দুই ব্রিফিংয়ে মুখপাত্রের কাছে দিল্লির অবস্থান জানতে চাওয়া হয়। জবাবে কেবলই বাংলাদেশের নির্বাচন বা ঘটনাপ্রবাহ ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলেন ভারত সরকারের মুখপাত্র জয়সওয়াল।

কিন্তু তাদের কাছে বিষয়টা ‘অভ্যন্তরীণ’ ছিল কেবল গত ৫ আগস্ট পর্যন্তই। সেদিন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটলে রাতারাতি ভোল পাল্টে যায় দিল্লির কর্তাব্যক্তিদের। পলাতক শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া ভারত একের পর এক বক্তব্য-বিবৃতি দিতে থাকে বাংলাদেশের বিষয়ে, তাদের গণমাধ্যমে চলতে থাকে সংঘবদ্ধ অপপ্রচার, যা ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’ উল্লেখ করে প্রতিবাদ পর্যন্ত করে ঢাকা।

অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের নাক গলাতে চাওয়ার সবশেষ নজির দেখা গেল গত ৭ মার্চ। সেদিন সাপ্তাহিক প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জয়সওয়াল। তিনি বলেন, ‘আমরা একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং প্রগতিশীল বাংলাদেশকে সমর্থন করি; যেখানে গণতান্ত্রিক উপায়ে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে সব সমস্যার নিষ্পত্তি হবে। ’

দেশের সিংহভাগের বেশি দলের বর্জন সত্ত্বেও ২০২৪ সালের ‘ডামি’ নির্বাচন আয়োজনকে ‘অভ্যন্তরীণ’ বিষয় বলেছিল যে ভারত, সেই তারা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার আগেই ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা বলায় বিভিন্ন মহলে উষ্মা প্রকাশ পাচ্ছে। অনেকে খোলাখুলি বলছেন, জুলাই অভ্যুত্থানে দেড় সহস্রাধিক ছাত্র-জনতা হত্যায় অভিযুক্ত আওয়ামী লীগকেই নির্বাচনে টানার জন্য ভারত এমন ‘বার্তা’ দিচ্ছে। যদিও জুলাই গণহত্যার বিচারের আগে নির্বাচন আয়োজন নিয়েই আপত্তি জানিয়ে আসছেন অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা। এমনকি জার্মানির নাৎসি পার্টি ও ইতালির ফ্যাসিস্ট পার্টির মতো আওয়ামী লীগকেই নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহলে।

বিগত তিন নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা
বাংলাদেশে নির্বাচনকেন্দ্রিক কেলেঙ্কারির শুরুটা হয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। দেশের নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পর ১৯৯০-এর দশকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু হয়। এই ব্যবস্থার অধীনেই পরবর্তী কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যদিও ২০০৮ সালের নির্বাচন আয়োজক সরকার ‘ওয়ান-ইলেভেন’র সরকার বলে আলোচিত। অনেকে মনে করেন, সেনাসমর্থিত এই সরকারের কার্যক্রম আওয়ামী লীগের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ছিল।

নবম সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। বিএনপি, জামায়াতসহ বিপুল সংখ্যক দল আওয়ামী সরকারের অধীনে ভোটে অংশ নেবে না বললেও শাসকগোষ্ঠী তা কানে তোলেনি। ‘সংবিধানের দোহাই’ দিয়ে তারা এক তরফা নির্বাচন আয়োজন করে। এতে সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ জনই বিনা ভোটে ‘নির্বাচিত’ হন।

দেশের সুশীল সমাজসহ পশ্চিমা বিশ্বও ওই নির্বাচন নিয়ে আপত্তি জানায়, কিন্তু এর পক্ষে সমর্থন আদায়ে খোলাখুলি অবস্থানে ছিল ভারত।

তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচনে করতে দেওয়া হবে না—বিরোধী দলগুলো এমন অবস্থানে যখন রাজপথে হরতাল-অবরোধ করছিল, তখন অর্থাৎ ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা সফরে আসেন ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। ওই পরিস্থিতি (প্রয়াত) জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির অবস্থান তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যদের বয়কটের কারণে প্রথম দিকে এরশাদও নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেন। এতে দেশে এক নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়, যার ফলে সংশয় দেখা দেয় ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নিয়ে। কিন্তু সুজাতা সিং সফরে এসে এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে এবং এক পর্যায়ে সরকার চাপ দিলে জাতীয় পার্টির এ নেতা নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হন।

বিবিসি বাংলার ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সফরে এসে সুজাতা সিং দেখা করেন জাতীয় পার্টির নেতা এরশাদের সঙ্গে। বলা হয়—তিনি (সুজাতা) তাকে (এরশাদকে) অনুরোধ করেছিলেন পরের বছর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য।

বিবিসি বাংলার ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নির্বাচনের অংশ নেওয়ার জন্য সুজাতা সিং এরশাদকে অনুরোধ করলেও তিনি তখন রাজি ছিলেন না। তবে সরকারের চাপে পড়ে এরশাদ শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। সেই নির্বাচনের এক মাস আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফরকে তখন অনেকেই বিবেচনা করেছিলেন বাংলাদেশের নির্বাচনের ওপর ভারতের প্রকাশ্য হস্তক্ষেপের এক দৃষ্টান্ত হিসেবে।

অনেকে মনে করেন, অতীতের নির্বাচনগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যৎসামান্য পারস্পরিক আস্থা থাকলেও ৫ জানুয়ারির ওই নির্বাচন সেই ভরসাটুকুর সমাধি রচনা করে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের দায় যতখানি, ততখানিই বর্তে তাদের পেছনে সমর্থন যোগানো ভারতের কাঁধে।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে হাসিনার সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দিলে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়ে বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যরা অংশ নেয়। ফলে ওই নির্বাচনে ভারতকে প্রকাশ্যে ততটা তৎপর হতে দেখা যায়নি। যদিও নির্বাচনে ভোট কারচুপি, আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরে ফেলা নিয়ে নানা সমালোচনা তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত বিএনপিসহ অন্যরা নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে পুনরায় ভোটের দাবি তোলে। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার সেই দাবি উড়িয়ে দিয়েছিল।

২০২৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বলা হয়, প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করলেও নির্বাচনে ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থন যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের দিকেই ছিল, তা অবশ্য দিল্লিতে কোনো গোপন বিষয় ছিল না।

নির্বাচনের পরদিন ৩১ ডিসেম্বর বিশ্বনেতাদের মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীই প্রথম শেখ হাসিনাকে ফোন করে অভিনন্দন জানান। সেজন্য শেখ হাসিনাও তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

দলীয় সরকারের অধীনে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে জালিয়াতি-কারচুপির কারণে বিএনপি, জামায়াতসহ বিরোধী অনেক দল হাসিনার সরকারের অধীনে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনও বয়কট করে। তারা তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন কোনো সরকার ব্যবস্থার আওতায় ভোট আয়োজনের দাবি জানায়। কিন্তু সংবিধানের দোহাই দিয়ে এ দাবিকে উড়িয়ে আওয়ামী লীগ এক তরফা নির্বাচনের দিকে এগোতে থাকে।

এই পরিস্থিতিতে ‍যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা কূটনীতিকরা সব দলের অংশগ্রহণে অন্তর্ভূক্তিমূলক ভোট অনুষ্ঠানে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন। তবে ভারত সরকার অবস্থান নেয় হাসিনার দলেরই পক্ষে। এই নির্বাচন বয়কটে বিরোধী দলগুলো আন্দোলন শুরু করলে ২০১৩ সালের ১১ আগস্ট বিষয়টি ওঠে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে।

সেখানে এক প্রশ্নের উত্তরে তৎকালীন মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত সরকারের মনোভাবের কথা আগেই জানিয়েছি। সেই মনোভাব এখনও অপরিবর্তিত। আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কী চলছে, সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা সমীচীন নয়। ’ ৭ জানুয়ারির ‘ডামি’ নির্বাচনের আগে ৫ জানুয়ারির ব্রিফিংয়ে আবারও বিষয়টি উঠলে নতুন মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ’

মূলত এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে এক তরফা নির্বাচনের আয়োজক হাসিনার সরকারের পেছনেই ভারতের অবস্থান প্রকাশ পায়। যদিও খোদ আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-নেতাদের বক্তব্যেই তাদের প্রতি দিল্লির প্রচ্ছন্ন সমর্থনের কথা উঠে আসে বিভিন্ন সময়ে। যেমন ওই নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের ৩ অক্টোবর ঢাকার আমিন বাজারে আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে দলের সাধারণ সম্পাদক (বর্তমানে পলাতক) ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তলে তলে আপস হয়ে গেছে। আমেরিকারও দিল্লিকে দরকার। আমরা আছি, দিল্লিও আছে; দিল্লি আছে, আমরাও আছি। ’

জুলাই গণহত্যাকালে যে ভূমিকা ছিল ভারতের
গত জুলাইতে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। প্রথমে এই আন্দোলন ছিল একেবারেই শান্তিপূর্ণ। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে শিক্ষার্থীদের দমনে মাঠে নামালে সহিংসতার শুরু হয়। আন্দোলনকারীদের শেখ হাসিনা ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে কটূক্তি করলে শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অগ্নিগর্ভ হলে আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে হাসিনার সরকার। একইভাবে লেলিয়ে দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের। তাদের  উন্মত্ততায় রাজপথে বয়ে যায় রক্তের নদী। এক পর্যায়ে আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের এক দফা দাবিতে। তীব্র জনরোষের মুখে শেখ হাসিনা আর টিকতে পারেননি। পালিয়ে যান ভারতে। তার আগে-পরে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী-এমপি ও নেতা-কর্মী।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, জুলাই-আগস্টে অভ্যুত্থান চলাকালে এক হাজার ৪শর বেশি মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই নিরাপত্তা বাহিনীর চালানো সামরিক অস্ত্র ও শটগানের গুলিতে মারা যান। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা গুরুতর আহত হয়েছেন। পঙ্গু হয়েছেন অনেকেই। অনেকের দুই চোখ, কারো কারো এক চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। ১১ হাজার সাতশর বেশি মানুষকে র‍্যাব ও পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

এই অভ্যুত্থানকালে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা এবং সংগঠনগুলো উদ্বেগ জানিয়ে মানবাধিকার সুরক্ষার আহ্বান জানালেও ভারতের অবস্থান স্বৈরাচার হাসিনার সরকারেরই পক্ষে প্রকাশ পায়। ২৫ জুলাই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে এ সংক্রান্ত প্রশ্ন করা হলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘বাংলাদেশের ঘটনাবলীর দিকে ভারত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছে। তবে সেখানে যা চলছে, তা সম্পূর্ণভাবে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ভারতের আশা, শিগগিরই বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। ’

অনেকের ধারণা, কূটনৈতিকভাবে এমন বক্তব্য দিয়ে ভারত হাসিনার দমন-পীড়নে নীরব সমর্থনই শুধু দেয়নি, অভ্যুত্থান দমনে যে কায়দায় নৃশংসতা চালানো হয়েছে, সেটাতেও ভারতের পরামর্শ-পরিকল্পনা ছিল। অনলাইনে এ সংক্রান্ত নানা কন্টেন্টও প্রচার করেছেন অ্যাক্টিভিস্টরাও।

যেভাবে ভোল পাল্টে গেল দিল্লির
৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের নির্বাচন ও ঘটনাপ্রবাহ ‘অভ্যন্তরীণ’ বলে পরোক্ষভাবে স্বৈরাচার হাসিনার পক্ষে অবস্থান নেওয়া ভারতের ভোল পাল্টে যায় চূড়ান্ত অভ্যুত্থানের পরপরই। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রোপাগান্ডা বা অপপ্রচার শুরু হয়। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে কিছু রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটলেও সেখানকার গণমাধ্যমে এসব সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বলে প্রচার হতে থাকে। তথ্য যাচাই সংস্থা রিউমর স্ক্যানারের হিসাব মতে, রাষ্ট্র ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর ১২ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত অন্তত ১৩টি ভুয়া খবর পাওয়া যায়। এমন ভুয়া খবর প্রচারের তালিকায় ভারতের অন্তত ৪৯টি গণমাধ্যমের নাম উঠে আসে। এসবের ওপর ভিত্তি করে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা এবং কেন্দ্রীয় সংসদে পর্যন্ত আলোচনা চলতে থাকে। অভ্যুত্থানকালের নৃশংসতা নিয়ে টু শব্দটি না করলেও সে দেশের কেন্দ্রীয় সংসদে আলোচনা হয় হাসিনার পতনের পেছনে চক্রান্ত আছে কি না সে বিষয়ে।

১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে দিল্লির লাল কেল্লায় ভাষণ দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, ‘১৪০ কোটি ভারতীয় বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, যারা শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছেন। ’

জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় সাবেক ইসকন নেতা চিন্ময় দাসকে গ্রেপ্তার করা হলে ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা তুঙ্গে ওঠে। এই উন্মাদনায় ২ ডিসেম্বর আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণে হামলা ও ভাঙচুর চালায় উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। অন্যদিকে বাংলাদেশে শান্তিরক্ষী পাঠানোর ব্যবস্থা নিতে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়।

১৩ ডিসেম্বর লোকসভায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, ‘সেখানে (বাংলাদেশে) সম্প্রতি উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের নিয়ে। আমাদের প্রত্যাশা, বাংলাদেশের পরিবর্তিত ব্যবস্থার সঙ্গে আমরা পারস্পরিক উপকারী এবং স্থিতিশীল সম্পর্কে আসতে পারব। ’

ডিসেম্বরে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি ঢাকা সফর করে যাওয়ার পর ৩ জানুয়ারি দিল্লিতে সেদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে মুখপাত্র জয়সওয়াল নতুন দুটি শব্দ যোগ করেন। তিনি বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সাম্প্রতিক ঢাকা সফরের পরই প্রেস বিবৃতির আকারে এই মনোভাব স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, ভারত একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল, ইনক্লুসিভ বাংলাদেশকে সমর্থন করে। ’ বছরখানেক আগেকার মন্তব্যের চেয়ে তার এই বক্তব্যে নতুন শব্দ দুটি হলো–গণতান্ত্রিক আর ইনক্লুসিভ (অন্তর্ভুক্তিমূলক)।

সবশেষ ৭ মার্চের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়েও জয়সওয়াল ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের কথা বলেন।

এছাড়া ৫ ফেব্রুয়ারি অনলাইনে পলাতক শেখ হাসিনার ভাষণ দেওয়া নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে একদল ছাত্র-জনতা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়ে তার পৈতৃক বাড়ি ভেঙে ফেলার পরও ভারত উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দেয়। সাতক্ষীরার যশোরেশ্বরী কালী মন্দিরের প্রতিমার মুকুট চুরি হওয়া নিয়ে পর্যন্ত বিবৃতি দেয় ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

ভারতের ভূমিকার সমালোচনা
৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন, হত্যা, গুম, ধর্ষণ, নিপীড়ন, নির্বাচনে কারচুপির বিষয়ে ভারত চুপ থাকতো বলে ঢাকাও তাদের কোনো ব্যাপারে আপত্তি বা অস্বস্তি প্রকাশ করেনি। এমনকি সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের বিষয়গুলোও ‘জানেন না’ বলে এড়িয়ে যেতেন হাসিনার সরকারের মন্ত্রী-কর্তারা।

ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিদায়ে ভারতের আকস্মিক চেহারা বদল হলে তার সঙ্গে মানিয়ে নেয় বাংলাদেশও। পতনের পর ঢাকার ভিন্ন আচরণ হজম করতে হচ্ছে ভারতকে। আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার আগেই এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশে চলমান অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে তা প্রতিবেশী মিয়ানমারসহ দেশের চারপাশে এবং ভারতের সেভেন সিস্টার্সে (সাত রাজ্য) ছড়িয়ে পড়তে পারে। ’

দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৬ আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ফোনালাপে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা সংক্রান্ত ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অতিরঞ্জিত ছিল। ’

হাসিনার শাসনামলে তাকে অকুণ্ঠ সমর্থনের জন্যও ভারতকে দোষারোপ করেন ড. ইউনূস। সেপ্টেম্বরে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়াকে (পিটিআই) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ককে বিশেষ মূল্য দেয়। কিন্তু ‘আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সব রাজনৈতিক দলকে ইসলামপন্থী এবং শেখ হাসিনা না থাকলে বাংলাদেশ আফগানিস্তানে পরিণত হবে’—নয়াদিল্লিকে অবশ্যই এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ”

সাবেক ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি, সেদেশের গণমাধ্যমের উন্মাদনার সমালোচনাও করে বাংলাদেশ সরকার।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঘটনায় ভারতের বিবৃতির জবাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য অপ্রত্যাশিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। ’

এছাড়া আগরতলা দূতাবাসে হামলা ও সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একাধিকবার ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনারকে তলব করে বাংলাদেশ সরকার।

গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সম্পর্ক এড়াতে হবে ভারতকে
জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকেও ভারতের সাম্প্রতিক নানা বক্তব্য-বিবৃতির সমালোচনা করা হয়েছে। অনেকে স্পষ্ট করে বলেছেন, প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে ভারতকে আওয়ামীমুখিতা ছাড়তে হবে। দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য দলগুলোরও এমন অবস্থান নিতে হবে, যাতে ভারত হাসিনার মতো কাউকে ‘বিশেষ আস্থাভাজন’ চিহ্নিত করে তাকে দুর্বল করতে না পারে এবং নিজস্বার্থ হাসিল করতে না পারে। যেন ন্যায্যতা ও অধিকারের প্রশ্নে দরকষাকষি ও আলোচনার সমান সুযোগ থাকে।

১৭ ফেব্রুয়ারি লালমনিরহাটে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের উদ্বোধনকালে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘ভারতকে পরিষ্কার করে বলতে চাই—আগেও বলেছি, এখনো বলছি। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে যদি বন্ধুত্ব করতে চান, আগে তিস্তার পানি দেন। সীমান্ত হত্যা বন্ধ করেন। আমাদের সঙ্গে বড় দাদাসুলভ আর মাস্তানির আচরণ বন্ধ করেন’।

পরদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একই কর্মসূচিতে বলেন, ‘আগস্টে খুনি স্বৈরাচার দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। এ স্বৈরাচার একদিন একটি কথা বলেছিল—ভারতকে যা দিয়েছি তা তারা (ভারত) সারাজীবন মনে রাখবে। তাই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত শুধু স্বৈরাচারকে মনে রেখেছে বাংলার মানুষকে মনে রাখেনি। প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশকে কিছু দেয় নাই শুধু দিয়েছে স্বৈরাচারকে। ’

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের এক বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে ২৪ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘তিনি ( জয়শঙ্কর) বলেছেন, কেমন সম্পর্ক চায় বাংলাদেশ, সেটা বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অবশ্যই বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নেবে, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক চায়। একইভাবে ভারতকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক চায়। ’

লেখক: সংবাদকর্মী