
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি করতে রাজনৈতিক দলের কাছে ২৭টি প্রস্তাব পাঠিয়েছে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’। মতামত দেওয়ার জন্য দলগুলো ১৩ মার্চ পর্যন্ত সময় পাচ্ছে। ঐকমত্য কমিশন বলছে, মতামত পাওয়ার পরই দলগুলোর সঙ্গে আলাদা আলাদা সংলাপ শুরু হবে। আর এই সংলাপের মধ্য দিয়ে আসবে নির্বাচনি রূপরেখা।
ঐকমত্য কমিশন প্রতিটি সুপারিশে দুই ক্ষেত্রে টিক দিয়ে সুস্পষ্ট মতামত চেয়েছে। প্রথমটিতে ‘একমত’; ‘একমত নই’ ও ‘আংশিকভাবে একমত’ হওয়ার বিষয় জানতে চাওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিনটি বিকল্পের যেকোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত জানাতে পারবে রাজনৈতিক দলগুলো। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সংস্কারের সময়কাল ও বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে ছয়টি বিকল্প প্রস্তাব দিয়ে মতামত চেয়েছে কমিশন। বিকল্পগুলো হলো, নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে, নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে, নির্বাচনের সময় গণভোটের মাধ্যমে, গণপরিষদের মাধ্যমে, নির্বাচনের পরে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে এবং গণপরিষদ ও আইনসভা হিসেবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে। এখানে যেকোনো একটিতে টিক চিহ্নের মাধ্যমে মতামত জানাবে রাজনৈতিক দলগুলো।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে প্রস্তাবনাসমূহ : রাজনৈতিক ঐকমত্য ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের নিয়োগ, দায়িত্ব ও ক্ষমতা এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট করা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়ন করা। একটি স্থানীয় জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রদান করা যেতে পারে, এজন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ দুই টার্মে সীমিত করা। দুইবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে অযোগ্য করা। একই ব্যক্তি একই সঙ্গে যাতে দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা হতে না পারেন, তার বিধান করা। ১০০ আসন নিয়ে সংসদের উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা। সংসদ নির্বাচনে ৩ শতাংশের অধিক প্রাপ্ত ভোটের হারের ভিত্তিতে (সংখ্যানুপাতিকভাবে) দলগুলোর মধ্যে আসন বণ্টন করা। উচ্চকক্ষের নির্বাচন প্রত্যেক দলের প্রাপ্ত আসনের ৫০টি দলের সদস্যদের মধ্য থেকে এবং ৫০ ভাগ আসন নির্দলীয় ভিত্তিতে নাগরিক সমাজ, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, মানবসেবা প্রদানকারী, শ্রমজীবীদের প্রতিনিধি, নারী উন্নয়নকর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ইত্যাদির মধ্য থেকে সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচিত করার বিধান করা। তবে শর্ত থাকে যে দলীয় ও নির্দলীয় সদস্যদের মধ্যে কমপক্ষে ৩০ ভাগ নারীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা। সংসদের উচ্চকক্ষের সদস্যদের বয়স কমপক্ষে ৩৫ বছর এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা কমপক্ষে স্নাতক নির্ধারণ করা। অন্যান্য যোগ্যতা-অযোগ্যতা নিম্নকক্ষের অনুরূপ করা। বিরোধী দলকে ডেপুটি স্পিকারের পদ দেওয়া। সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ৪০০ প্রতিনিধির সমন্বয়ে নিম্নকক্ষ গঠিত হবে। প্রস্তাবিত ৪০০ আসনের মধ্যে ৩০০টি আসন উন্মুক্ত থাকবে এবং ১০০টিতে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে কেবল নারী প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। দলনিরপেক্ষ, সৎ, যোগ্য ও সুনামসম্পন্ন ব্যক্তির রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার বিধান করা। জাতীয় সংসদের উভয় কক্ষের সদস্য এবং স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত বৃহত্তর নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার বিধান করা। বিরোধী দলকে ডেপুটি স্পিকার পদ দেওয়ার বিধান করা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ চার মাস নির্ধারণ করা এবং এ মেয়াদকালে জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচন সম্পন্ন করা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সরকার পরিচালনায় রুটিন কার্যক্রমের বাইরেও সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিবিধানের সংস্কার এবং প্রশাসনিক রদবদলের ক্ষমতা প্রদান করা। স্থায়ী জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের নাম চূড়ান্ত করা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান অন্য ২০ জন উপদেষ্টাকে নিয়োগের বিধান করা। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজন করা। ভবিষ্যতে সীমানা নির্ধারণের জন্য একটি আলাদা স্বাধীন সীমানা নির্ধারণ কর্তৃপক্ষ গঠন করা। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের কাছে হস্তান্তর করা। নির্বাচন কমিশনের আইনি, আর্থিক ও প্রশাসনিক প্রস্তাব কোনো মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষের স্পিকারের নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির কাছে উপস্থাপনের বিধান করা। সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কিংবা শপথ ভঙ্গ করলে কমিশনারদের মেয়াদ পরবর্তী সময়ে, প্রস্তাবিত সংসদীয় কমিটি ‘উত্থাপিত অভিযোগ’ তদন্ত করে সুপারিশসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের বিধান। সংবিধানের ৭৮(৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সংসদের কমিটিসমূহের এবং সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার নির্ধারণ করা। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর আওতাভুক্ত করা হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত করার লক্ষ্যে মানবতা বিরোধী (ট্রাইব্যুনাল) আইন ও আরপিও সংশোধন করার প্রস্তাব রয়েছে।