
বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ গত ১৬ বছরে ব্যাপকভাবে বেড়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ৭৪.৪০ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় আট লাখ ৯২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২০ টাকা হিসাবে)। এর মধ্যে ৩৯.৩১ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় চার লাখ ৭১ হাজার ৭২০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হলেও মোট ঋণের পরিমাণ এবং পরিশোধের চাপ উভয়ই বেড়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষে দেশের মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৮.১৮ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৯ লাখ ৩৮ হাজার ১৬০ কোটি টাকা, যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ছিল ২১ বিলিয়ন ডলার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঋণের একটি বড় অংশ অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করা হয়েছে, তবে অনেক প্রকল্প থেকে প্রত্যাশিত রাজস্ব আয় না আসায় ঋণ পরিশোধের চাপ ক্রমেই বাড়ছে। সহজ শর্তের ঋণের পরিমাণ কমে আসছে এবং কঠোর শর্তযুক্ত ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতির জন্য আরো সংকট তৈরি করতে পারে।
ঋণ পরিশোধের ক্রমবর্ধমান চাপ : বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের খরচ গত কয়েক বছরে দ্রুত বেড়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারকে ৬.০৮ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৭২ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় এটি ২৭ শতাংশ বেশি।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়েছিল ৪.৭৮ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৫৭ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা) এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে পরিশোধিত ঋণের পরিমাণ ছিল ৩.৬১ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৪৩ হাজার ৩২০ কোটি টাকা)।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ঋণ পরিশোধের ক্রমবর্ধমান ব্যয় সরকারের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয়ের সুযোগ সংকুচিত করে দিচ্ছে। বিশেষ করে এই বাস্তবতায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাজেট কমার আশঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমছে, কারণ রাজস্ব বৃদ্ধির তুলনায় ঋণের বোঝা অনেক দ্রুত বাড়ছে। যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে সরকারকে নতুন ঋণ নিয়ে পুরনো ঋণ পরিশোধ করতে হবে, যা দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতির ওপর গুরুতর চাপ সৃষ্টি করবে।
বড় প্রকল্প ও ঋণের বাস্তবতা : গত এক দশকে বাংলাদেশ বেশ কিছু বৃহত্ অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, যার মধ্যে রয়েছে পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, বঙ্গবন্ধু টানেল এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র। তবে অনেক প্রকল্প থেকে প্রত্যাশিত রাজস্ব আয় আসেনি, ফলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তাফা কে মুজেরি কালের কণ্ঠকে বলেন, অনেক অবকাঠামো প্রকল্প থেকে প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে এসব প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণ পরিশোধে সরকারকে বাড়তি চাপ নিতে হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতার কারণে সরকারকে তাদের ঋণও বহন করতে হচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্য দীর্ঘ মেয়াদে বিপজ্জনক হতে পারে।
সুদের হার ও পরিশোধের সময় কমছে : ইআরডির প্রতিবেদন অনুসারে বৈদেশিক ঋণের সুদের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের গড় সুদের হার ছিল মাত্র ০.৯ শতাংশ, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৩ শতাংশে। অর্থাত্ মাত্র কয়েক বছরে সুদের হার প্রায় ২.৫ গুণ বেড়েছে।
একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের গড় সময়সীমা কমে গেছে। ২০১৬ সালে যেখানে পরিশোধের গড় সময় ছিল ১২.৩ বছর, সেখানে বর্তমানে এটি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮.৫ বছর। অর্থাত্ কম সময়ে বেশি ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে, যা বাজেট ব্যবস্থাপনার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।
বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন যে আগামী কয়েক বছরে বেশ কিছু বড় প্রকল্পের ঋণের কিস্তি এবং সুদ পরিশোধ একসঙ্গে শুরু হবে। বিশেষ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল এবং মেট্রো রেলের মতো প্রকল্পগুলোর ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে আসছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বড় ধরনের চাপ পড়তে পারে।
ভবিষ্যত্ করণীয় : বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ঋণ ব্যবস্থাপনায় এখনই পরিবর্তন আনা না হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে মারাত্মক আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হতে হবে। নতুন ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হতে হবে এবং সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে হবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, করব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করতে হবে, কর ফাঁকি রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং রপ্তানি আয় বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি সহজ শর্তের ঋণের দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে ঋণ পরিশোধের চাপ সহনীয় মাত্রায় থাকে।
বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, সরকার যদি এখনই ঋণ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন না আনে, তাহলে আগামী কয়েক বছরে বাজেট ঘাটতি আরো বাড়বে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হবে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়তে পারে।