
আবাসন খাতের গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সর্বশেষ প্রণীত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)। চাপিয়ে দেওয়া এই ড্যাপের কারণে নতুন করে ভবন নির্মাণের কাজ থমকে গেছে। ফলে নির্মাণ উপকরণের দাম কমলেও আগ্রহ দেখাচ্ছেন না জমির মালিকরা। তবে আশার কথা হলো, নতুন করে সংশোধন হতে যাচ্ছে ড্যাপ।
ফলে রাজধানীর ভবনগুলোর উচ্চতা, আয়তন ও ইউনিট বাড়বে। এরই মধ্যে এসংক্রান্ত কাজ অনেকটা গুছিয়ে আনা হয়েছে বলে জানা গেছে।
খাতসংশ্লিষ্ট বক্তিরা বলেন, ড্যাপে জনঘনত্ব ও অন্যান্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে ভবনের উচ্চতা বেঁধে দেওয়া হয়। এ জন্য বিভিন্ন মহল, বিশেষ করে স্থপতি ও আবাসন ব্যবসায়ীরা বেঁকে বসেন।
শুরু হয় ড্যাপের নানা সংশোধন। আগে প্রশস্ত রাস্তা না থাকলেও আট থেকে ১০ তলা পর্যন্ত ভবন করা যেত। কিন্তু গেজেট আকারে ড্যাপ প্র্রকাশ হওয়ার পর সেই সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। অপ্রশস্ত রাস্তার ক্ষেত্রে চার থেকে পাঁচতলা ভবন নির্মাণের বিধান রাখা হয়। ফলে জমির মালিক, হাউজিং প্রতিষ্ঠান, ডেভেলপারদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। তাঁরা বাণিজ্যিকভাবে বাড়ি ও ভবন নির্মাণ তুলনামূলক কমিয়ে দেন। বেড়ে যায় রাজধানীর ফ্ল্যাটের দাম। বাড়তে থাকে বাড়িভাড়াও।
আবাসন খাতের শীর্ষ সংগঠন রিহ্যাবের সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আবাসন খাতে বর্তমান পরিস্থিতি বেশ মন্দা। তবে এর আগের এই খাতের বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)। ২০২২ সালের ড্যাপ বাস্তবায়নের পর থেকে প্ল্যান পাস করতে পারছেন না অনেক উদ্যোক্তা। এর ফলে ভূমি উন্নয়নকারী ও ভবন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্ল্যান পাসের নিয়ম সহজ করা না হলে এই খাত গভীর সংকটে পড়বে।
তিনি বলেন, ‘আমরা রাজউকের কাছে আপত্তি জানিয়েছি। বৈঠকের পর বৈঠক হচ্ছে। তবে আশার কথা, চলতি মাসেই ড্যাপের নতুন সংশোধনীর অনুমোদন দেওয়া হতে পারে।’
আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, রিয়েল এস্টেট খাতের উদ্যোক্তা ও যাঁরা ফ্ল্যাট নির্মাণের সঙ্গে জড়িত তাঁরা খুব কঠিন সময় পার করছেন। এর পেছনে বড় কারণ বর্তমান রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও ড্যাপের প্রভাব। এর সঙ্গে নির্মাণসামগ্রীর দাম এবং ব্যাংকের ইন্টারেস্ট রেটও অনেকাংশে দায়ী। সব কিছু মিলিয়েই রিয়েল এস্টেট কঠিন মন্দাকালীন সময় পার করছে।
তাঁরা আরো জানান, মূলত ড্যাপের প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই আবাসন খাতে ব্যাপক মাত্রায় স্থবিরতা নেমে আসে। ড্যাপ সংশোধন না হলে ভবিষ্যতে এই সংকট আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। বিগত সরকার প্রণীত ‘বৈষম্যমূলক ও ত্রুটিপূর্ণ’ ড্যাপের (২০২২-২০৩৫) কারণে খালবিল, জলাশয় ও কৃষিজমি দ্রুতগতিতে হ্রাস পাবে, যা ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকর হবে। তা ছাড়া এই প্রকল্প ঢাকাকে বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে নয়, বরং এই প্রকল্প তৈরি হয়েছিল কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের সুবিধা ভোগের জন্য। তাই এই প্রকল্প বাদ দিয়ে নতুন প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ তাঁদের।
রাজধানী ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) একটি মাস্টারপ্ল্যানের গ্যাজেট প্রকাশ করেছিল, যার নাম ‘ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান’ বা সংক্ষেপে ড্যাপ। এর মেয়াদ ধরা হয় ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত। ২০২২ সালের ২২ আগস্ট ড্যাপের গেজেট (২০২২-৩৫) প্রকাশ হয়। কিন্তু গেজেট প্রকাশের পর থেকেই এ নিয়ে নানান আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। পরের বছর ২০২৩ সালে কিছু সংশোধনী এনে আবারও গেজেট প্রকাশ করা হয়। সম্প্রতি সরকারের পটপরিবর্তনের পর এই আলোচনা নতুন করে সামনে এসেছে। কেউ বলছেন এই প্রকল্প বাতিল করতে হবে। আবার কেউ বলছেন, এটি বাতিল নয়, বরং সংশোধন করা দরকার।
রাজউক সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালে প্রকাশ করা ড্যাপের নতুন গেজেট (২০২২-৩৫) অনুযায়ী ভবন নির্মাণে ফার (ফ্লোর এরিয়া রেশিও), রাস্তার প্রশস্ততা, ভবনের উচ্চতাসহ নানা বিষয়ে কড়াকড়ি শর্ত থাকায় রাজধানীতে ভবন নির্মাণে ধস নামে। ওই গেজেট প্রকাশ হওয়ার পর অন্যান্য সময়ের তুলনায় রাজউক থেকে ভবনের নকশা অনুমোদনের হার অর্ধেকে নেমে আসে।
পরে রিহ্যাবসহ ভবন নির্মাতাদের দাবি ও সমালোচনার মুখে ২০২৩ সালের সংশোধিত ড্যাপে কিছুটা ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) সুবিধা বাড়ানো ও সামনের রাস্তার প্রশস্ততার ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়। তবে এতেও নকশা অনুমোদনের হালে পানি পায়নি।