
বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে দেশের আবাসন খাত। তবে এ খাতটি এখন ক্রান্তিকাল পার করছে। প্লট, ফ্ল্যাট ও বাড়ি বিক্রিতে মন্দার কারণে এ খাতজুড়ে চরম স্থবিরতা। নতুন বিনিয়োগ না হওয়া ও পুরনো প্রজেক্ট প্রায় অচল হয়ে থাকায় উদ্যোক্তারাও পরিচালন ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
সব মিলিয়ে বলা যায়, খাতটি এখন কঠিন সংকটে। উদ্যোক্তারা জানান, অন্তত ৬০ শতাংশ ব্যবসা মন্দার কবলে। এর ধাক্কা এসে লেগেছে আবাসন খাতের সঙ্গে জড়িত রড-সিমেন্টসহ অন্তত আড়াই শ উপখাতেও। বিপুল কর্মসংস্থানের এ খাতের শ্রমিকের জীবন যাপনও হুমকিতে পড়েছে। আবাসন খাতকে চাঙ্গা করতে অবিলম্বে ড্যাপ সংশোধনসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
আবাস খাতের সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা ও শিল্পের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এ খাতটিতে এখন নীরব মন্দা চলছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের মনোযোগের বাইরে চলে যাওয়া বড় বিনিয়োগের এ খাতটি ২০২৩ অর্থবছরেও বাংলাদেশের জিডিপিতে প্রায় ৮ শতাংশের মতো অবদান রেখেছিল। এ খাতে বিনিয়োগ দেড় লাখ কোটি টাকারও বেশি। সরাসরি কমবেশি ৩৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এ খাতে।
জানা যায়, বর্তমানে সারা দেশে বছরে অন্তত এক লাখ নতুন অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদা রয়েছে। আবাসন খাতেরও সক্ষমতা রয়েছে এ চাহিদা পূরণের। তবে এখন ব্যবসা মন্দার কারণে উদ্যোক্তারা মাত্র ৮ শতাংশ অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদা পূরণ করতে পারছেন। ফলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহে একটি বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে গেছে।
এর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে—ক্রেতাদের সক্ষমতা নেই। উচ্চ সুদের কারণে বেশির ভাগ ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে নতুন অ্যাপার্টমেন্ট কেনার সক্ষমতা। মানসম্পন্ন অ্যাপার্টমেন্ট বলতে গেলে মধ্যবিত্তের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ভালো জায়গায় বাসযোগ্য একটি ফ্ল্যাটের দামও এখন ন্যূনতম দেড় কোটি টাকা। এ রকম একটি ফ্ল্যাটের জন্য কেউ ব্যাংক ঋণ নিলেও তাঁকে অন্তত ৩০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। এ জন্য মাসে ন্যূনতম এক লাখ টাকার বেশি আয় থাকতে হবে। এটিও ফ্ল্যাট বিক্রিতে সংকট তৈরি করেছে বলে উদ্যোক্তারা জানান।
তথ্য বলছে, মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম এ খাতে এখন হচ্ছে না নতুন বিনিয়োগ। অনেক কম্পানি পরিচালন খরচ মেটাতে লাভ না করেই প্লট-ফ্ল্যাট ছেড়ে দিচ্ছে। অনেক আবাসন প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো বেতন দিতে পারছে না কর্মীদের। নানামুখী প্রতিবন্ধকতা গ্রাস করছে শিল্পটিকে। গত কয়েক বছর ধরেই জমির অভাব, নগর পরিকল্পনার অভাব এবং দক্ষ শ্রমিকের অভাবের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আসছিল আবাসন খাত। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণের বাড়তি সুদ এবং নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির মতো ঘটনা। সব কিছু ছাপিয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে ড্যাপ সংশোধন না হওয়া। ২০২২ সালে উদ্যোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এই ড্যাপের কারণে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে শিল্পটি। এর পর থেকে নতুন উদ্যোগ ও বিনিয়োগ বলতে গেলে তলানিতে এসে ঠেকেছে।
আবাসন খাতের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-রিহ্যাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আবাসন খাত এখন সবচেয়ে সংকটময় সময় পার করছে। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হলো—ড্যাপ সংশোধন না হওয়া। ড্যাপ পুনর্বিবেচনা না করলে এ খাত অগ্রসর হতে পারবে না। এখন বলতে গেলে প্ল্যানই বন্ধ। ফ্ল্যাটের বিক্রি বন্ধ অন্তত ৬০ শতাংশ। কোনো কাজকর্ম নেই। আবাসন খাতের সঙ্গে সরাসরি জড়িত রড-সিমেন্টসহ বিভিন্ন ধরনের প্রায় ২৫০ শিল্পের অবস্থাও খারাপ। একটা না চললে আরেকটা চলে না। সরাসরি ৩৫ লাখ শ্রমিকের জীবনজীবিকাও এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। পরোক্ষভাবে প্রায় দেড় কোটি মানুষ এ খাতের সঙ্গে জড়িত। তারাও এখন অনিশ্চয়তায়।’
উদ্যোক্তারা আরো জানান, রাজধানীতে ছোট ও মাঝারি ফ্ল্যাট বুকিং ও বিক্রি এক বছরের ব্যবধানে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমেছে। ভালো মানের বা বিলাসবহুল ফ্ল্যাট বিক্রি প্রায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। ফ্ল্যাট বুকিং ও বিক্রি কমে যাওয়ায় ছোট ও মাঝারি আবাসন খাতের উদ্যোক্তারা আর্থিক সংকটে পড়েছেন। পাশাপাশি প্লট বা জমি বিক্রির পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। মূলত রড ও সিমেন্টের মতো কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ড্যাপের কারণে ফ্ল্যাটের নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ।
এতে আবাসন খাতে নতুন প্রকল্পের সংখ্যা কমে গেছে। একই সঙ্গে ব্যক্তি উদ্যোগে বাড়ি নির্মাণের কাজেও স্থবিরতা চলছে। একই সঙ্গে মিলছে না চাহিদামতো ব্যাংকঋণ। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতায় সাত মাস ধরে ফ্ল্যাটের বিক্রি কম থাকায় অনেক ছোট প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন ও অফিসের ভাড়া দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্মাণ ব্যয়ে মুনাফা ছাড়া ফ্ল্যাট বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কেউ কেউ।
আবাসন খাতের উদ্যোক্তা ও জেসিএক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল হোসেন চৌধুরী জুয়েল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশের ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিবিদদের একটি অংশ সব সময় আবাসনে বিনিয়োগ করে থাকে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ আত্মগোপনে। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আবাসনে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ। ফলে এ খাতে বিনিয়োগও কমে গেছে। মানুষও আগের মতো কিনছেন না। আগে যাঁরা বড় আকারের ফ্ল্যাট কিনতেন, তাঁরা এখন নেই। উল্টো তাঁরাই এখন নিজেদের সম্পদ বিক্রিতে নেমেছেন।’
ড্যাপের কারণে ব্যবসায় মন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নতুন ড্যাপের কারণে ২০২৩ সাল থেকেই আমাদের আবাসন খাত মন্দা, যার কারণে রাজউকে নতুন প্ল্যান পাস করানো বন্ধ রাখেন উদ্যোক্তারা। ফলে এ সময় যে পরিমাণ প্রকল্প হওয়ার কথা ছিল, সেই রকম হয়নি। নতুন সরকার গঠন করার পর আবাসন খাতের পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। যাঁরা আগে বুকিং দিয়েছিলেন তাঁরাও নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করছেন না। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ড্যাপ সংশোধন করার বিষয়টি মেনে নিয়েছে। আমরা আশা করছি, দ্রুতই এটি পরিবর্তন হবে, এতে এই খাত আবার ঘুরে দাঁড়াবে।’
জানা যায়, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে ফ্ল্যাট বিক্রি আরো কমেছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ঢাকায় ফ্ল্যাট বুকিং ও বিক্রি কমে গেছে। একান্তই প্রয়োজন না হলে কেউ ফ্ল্যাট কিনছেন না।
উদ্যোক্তারা জানান, ‘বিশ্বের অনেক দেশেই ২৫ থেকে ৩০ বছরের জন্য গৃহঋণ দেওয়ার জন্য মর্টগেজ করপোরেশন রয়েছে। সেসব দেশের ফ্ল্যাটের ক্রেতারা ৩০ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করে মর্টগেজ করপোরেশনে আবেদন করেন। তখন ওই সংস্থা তাঁদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়। আমাদের দেশেও এমন ব্যবস্থায় যেতে হবে।’
রিহ্যাব সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতির মতো স্থবিরতা নেমে এসেছে আবাসন খাতে। এ খাতের সঙ্গে জড়িত উপখাত যেমন সিমেন্ট, রড, ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি, টাইলস, রং, পাইপ ফিটিংস, স্যানিটারি ইত্যাদি ব্যবসা ঝুঁকির মধ্যে। এসব খাতের সঙ্গে পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকাও থমকে আছে। দ্রুত এ খাত উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি বলে উদ্যোক্তারা মনে করেন।
তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় আরো জানা যায়, স্বাভাবিক সময়ে দেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার ফ্ল্যাট বেচাকেনা হতো। লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এখন বেচাকেনা নেই বললেই চলে। ফলে নির্মাণশিল্পের সঙ্গে জড়িত ৩৫ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে। শুধু স্টিল খাতেই গত তিন মাসে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আবাসন ও নির্মাণ খাতের কাজ বন্ধ থাকার পাশাপাশি সরকারের মেগাপ্রকল্পগুলোর কাজও প্রায় বন্ধ। থমকে আছে অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নের কাজও। ফলে ৯০ শতাংশ সিমেন্ট কারখানারই উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ এই সিমেন্টশিল্প দেশের নিজস্ব চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি একটি রপ্তানিমুখী খাত হয়ে উঠেছিল। ডেভেলপাররা ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে নির্মাণকাজ অর্ধেক করে বসে আছেন। এতে ঋণের সুদ বাবদ বিপুল ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে তাঁদের।
জানা যায়, অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের নিবন্ধন ব্যয় অনেক বেশি। রয়েছে ভ্যাট-ট্যাক্সের হারও বেশি। এ জন্য নিবন্ধন ফি, ভ্যাট-ট্যাক্স উল্লেখযোগ্য হারে কমানোর দাবি দীর্ঘদিনের। নতুন করে এ খাতের মন্দা কাটাতে আসছে বাজেটে বিনা শর্তে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ফ্ল্যাট, প্লট বা জমি কিনতে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা বিনিয়োগ করার সুযোগ দেওয়ার কথাও এরই মধ্যে উঠেছে।