উদ্ধার করতে ডিআইএর সুপারিশের চিঠি মন্ত্রণালয়ে চার বছর ধরে ফাইলবন্দি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩৪৮ একর জমি বেহাত হয়ে গেছে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত বিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি মিলিয়ে সারা দেশের প্রায় ১ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল সরকারের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। এসব জমি উদ্ধারে সুপারিশও করা হয়েছিল। কিন্তু প্রায় চার ধরে সেটি ফাইলবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে। ডিআইএর সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি।
এদিকে ঢাকার ৩৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে অন্তত ৪৮টিতে দখলদারদের থাবা পড়েছে। এগুলোর ভবন, জমি দখল করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা গড়ে তুলেছেন কমিউনিটি সেন্টার, গ্যারেজ, দোকান, ক্লাবঘর, বস্তি, কাঁচাবাজারসহ নানা প্রতিষ্ঠান। ২০১৪ সালের ২২ অক্টোবর দশম জাতীয় সংসদের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে রাজধানীর প্রাথমিক স্কুলের জমি অথবা ভবন দখলমুক্ত করতে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা সরেজমিন পরিদর্শন করে ঐ বছরই প্রতিবেদন তৈরি করে। সে সময় কমিটি দখলকৃত ৪৮টি বিদ্যালয়ের জমি ও ভবন উদ্ধারের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করে। জমি উদ্ধারে ২০১৪ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) এবং ঢাকার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে (ডিপিইও) দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু নানা কারণে গত ১১ বছর ধরে তা উদ্ধার করা হয়নি। জানা গেছে, ৪৮ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেদখল জমির পরিমাণ প্রায় ১৮ বিঘা।
১৬টি বিদ্যালয়ের জমি দখল করেছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। পাঁচটির জমিতে পানির পাম্প করেছে ঢাকা ওয়াসা। বাকি জমি গেছে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার, বস্তি, দোকান এবং ধর্মীয় স্থাপনায়।
সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খাস খতিয়ানভুক্ত বা অধিগ্রহণ করা কোনো জমি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে রেকর্ড হয়েছে কি না তার তথ্য চেয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর। গত ৮ ডিসেম্বর জারি করা মাউশির চিঠিতে বলা হয়েছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর অধীন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খাস খতিয়ানভুক্ত-অধিগ্রহণকৃত জমি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে রেকর্ডভুক্ত হয়েছে কি না বা এই সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কী ব্যবস্থা নিয়েছে তার বিস্তারিত তথ্য আগামী ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে প্রমাণসহ প্রতিবেদন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের বিশেষ শিক্ষা শাখার উপপরিচালক ও মাউশির জমির দলিলাদি সংরক্ষণ সংক্রান্ত কমিটির আহ্বায়ক মো. তারিকুল ইসলামের দপ্তরে পাঠাতে হবে। জানা গেছে, অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথ্য এখনো পাঠায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলেন, ডিআইএর তদন্তে যেহেতু অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তাই নতুন করে তথ্য চাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এখন প্রয়োজন জমি উদ্ধারে কার্যকরী পদক্ষেপ।
যেসব স্কুলের জায়গা বেদখল:১৯৭৯ সালে ডিআইএ প্রতিষ্ঠা হয়। এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সংস্থা। শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন এবং আর্থিক স্বচ্ছতা আনতে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন ও নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয় তারা। অবশ্য কখনো কখনো এই প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও পরিদর্শনের সময়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ডিআইএর পরিদর্শন ও অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, ঢাকার রমনা, শান্তিগনগর এলাকায় নয়াটোলা এ ইউ এন মডেল কামিল মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৭০ সালে। অনুমোদনের সময় ৯৩ শতাংশ জমি দেখানো হলেও বর্তমানে জমি রয়েছে ৭১ দশমিক ৮৯ শতাংশ। যাত্রাবাড়ী মান্নান হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। অনুমোদনের সময় ৫৯ দশমিক ২৮ শতাংশ জমি খারিজ করা হয় প্রতিষ্ঠানের নামে। আরো ২৬ দশমিক ৪০ শতাংশ জমি প্রতিষ্ঠানের নামে কিনতে তহবিল থেকে ব্যয় করা হয় ১৫ লাখ টাকা। ডিআইএর সবশেষ পরিদর্শনে সেখানে ৮৪ দশমিক ৯০ শতাংশের বদলে ৩০ শতাংশ জমির অস্তিত্ব মেলে। বাকি জমির কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। ডিআইএর তথ্যমতে, আগের চেয়ে জমি কমে যাওয়া একটি প্রতিষ্ঠান গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার কে কে টি হাজী এন সি ইনস্টিটিউট। ৭৪ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান ২৭ বছর আগে একবার পরিদর্শন করেছিল ডিআইএ। তখন বিদ্যালয়ের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরিদর্শন প্রতিবেদনে বিদ্যালয়ের জমির পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৩৯ একর। ডিআইএ ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটি আবারও পরিদর্শন করে ঐ বছরের গত ২১ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যে প্রতিবেদন জমা দেয়, তাতে বলা হয় বিদ্যালয়টির জমির পরিমাণ ৩ দশমিক ৪০ একর। ২৭ বছরে কমেছে প্রায় এক একর জমি। ঢাকার গেন্ডারিয়ায় শ্যামপুরে ফজলুল হক মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৭০ সালে। শুরুতে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ২ দশমিক ৩২ একর জমি থাকলেও বর্তমানে ১ দশমিক ০৫ একর জমি রয়েছে। পরিদর্শনে এক একরের বেশি জমি বেহাত হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে ডিআইএ।
ডিআইএর শীর্ষস্থানীয় একজন কর্মকর্তা বলেন, একসময় অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনেক বেশি জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জমি নানাভাবে বেহাত ও বেদখল হয়েছে। এসবের অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি এবং প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের যোগসূত্র রয়েছে বা তাদের অবহেলায় জমি বেহাত হয়েছে। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদনের সময় যে পরিমাণে জমির কাগজপত্র দেখানো হয়েছে পরে সেখানে পরিদর্শন করতে গেলে সে পরিমাণে জমি পাওয়া যায়নি। কোথাও কোথাও পাঠদান অনুমোদন, পাঠদান স্বীকৃতি ও পরে এমপিওভুক্তি হওয়ার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জমির একটি অংশ বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং কমিটি ও প্রতিষ্ঠান প্রধান মিলে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন সেই অর্থ। অনেক স্থানে আবার বিত্তশালী ব্যক্তিরা স্কুল-কলেজের জন্য বিপুল পরিমাণে জমি দান করে অন্যত্র চলে গেলে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি সেসব জমি দখল করে নিয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে পরিদর্শনে গিয়ে সেখানে জমির পরিমাণ যাচাই-বাছাইয়ে ধরা পড়ছে অসঙ্গতি।