
দেশজুড়ে ছড়িয়েছে ধর্ষণ আতঙ্ক। অবস্থা এতই ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ধর্ষক ও দুর্বৃত্তের লালসা থেকে অবুঝ শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ নারী কেউ রেহাই পাচ্ছে না। ঢাকা ছাড়াও দেশের আনাচকানাচে পৈশাচিক এই নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে নারী-শিশুদের। ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দিতে অপরাধী এবং তাদের সহযোগীরা ভিকটিমকে হত্যা করতেও কুণ্ঠাবোধ করছেন না। আতঙ্কের বিষয়, চলন্ত গণপরিবহনের নারীরাও আর নিরাপদ নন। সেখানেও তারা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এই অবস্থায় দেশব্যাপী নারী ও কন্যাশিশুর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। কর্মজীবী নারী ও মেয়েশিক্ষার্থীরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত। দুশ্চিন্তায় অভিভাবকরাও। এরই মধ্যে ধর্ষকদের শাস্তির দাবিতে এবং এর প্রতিবাদে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে। তারা মশাল মিছিল করেছে এবং প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথাযথ নজরদারির অভাবে দেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। নারী নেত্রীরা বলছেন, যখন একটি দেশে ‘চেইন অব কমান্ড’ বা নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় সব দিক দিয়ে দুর্বলতা থাকে তখন অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। এজন্য ধর্ষণের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও শক্ত হতে হবে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যে, ২০২৪ সালে দেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় মোট ৪০১ জন নারী-শিশু। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয় ৩৪ জন। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করে ৭ জন। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মোট ৩৯ জন নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে ১৮ জন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। গত মাসে ২৯৫টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। যা গত মাসের তুলনায় ২৪টি বেশি। ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৫৭টি। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ১৭টি এবং হত্যার ঘটনা ঘটে ২টি। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫ জন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারী। ধর্ষণের শিকার ৫৭ জনের মধ্যে ১৬ জন শিশু, ১৭ জন কিশোরী, আর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ৩ জন কিশোরী ও ১৪ জন নারী। ধর্ষণ ও হত্যার শিকার ২ জন নারী। মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) এর তথ্যে এমনটি জানা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, এখন পুলিশ বাহিনী পরিপূর্ণভাবে দায়িত্বে নেই। পুলিশের জনবলেও ঘাটতি আছে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েই এখন সবাই ব্যস্ত। ফলে যে অপরাধীরা এখন অপরাধ করছে তারা ধরেই নিয়েছে যে পুলিশ বাহিনী এখন নিষ্ক্রিয় আছে। এ সুযোগে তারা অপরাধ করছে। আবার থানায় গিয়ে অভিযোগ জানালেও পুলিশ সদস্যরা খুব একটা যে তৎপর এমন না। ইউটিউবের সহজলভ্যতার কারণে মানুষ সহজেই বীভৎস সব ভিডিও দেখছেন। সেগুলো আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করছেন অনেকে। এসব কনটেন্ট দেখে অপরাধমনস্ক ব্যক্তিরা এ ধরনের অপরাধমূলক কাজে উৎসাহিত হচ্ছেন। নারী নেত্রী ও মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শক্তভাবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। যখন ‘চেইন অব কমান্ড’ বা নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় সব দিক দিয়ে দুর্বলতা থাকে তখন অপরাধীরা পার পেয়ে যেতে পারে। এই সমাজব্যবস্থায় পুরুষরা সুযোগ পেলে অপরাধ হিসেবে ধর্ষণই বেশি করে। কারাগার থেকে গত কয়েক মাসে অনেক অপরাধীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এদের অনেকেই এবং তাদের সিন্ডিকেট এ ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত। ধর্ষণের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও শক্ত হতে হবে।
মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া আট বছরের শিশুকে ৫ মার্চ রাতে ভয়াবহ যৌন নির্যাতন করা হয়। শিশুটির বোনের স্বামীর সহায়তায় তার বাবা (শ্বশুর) শিশুটিকে ধর্ষণ করেন। আর এই বিষয়টি শিশুটির বোনের শাশুড়ি ও ভাশুর জানতেন। তারা ঘটনা ধামাচাপা দিতে শিশুটিকে হত্যাচেষ্টা চালান। বর্তমানে শিশুটিকে অত্যন্ত আশঙ্কাজনক অবস্থায় রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। মাগুরায় শিশু ধর্ষণের ঘটনার রেশ না কাটতেই ঢাকার কেরানীগঞ্জে এক অন্তঃসত্ত্বা তরুণী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। ৮ মার্চ রাতে দক্ষিণ পানগাঁও এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে নিখোঁজের তিন দিন পর একটি পুকুর থেকে এক স্কুলছাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। যাকে ধর্ষণচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার আইসক্রিম বিক্রেতা সাব্বির খানের দেওয়া তথ্যে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত দেড়টার দিকে উপজেলার পূর্ব রশুনিয়া গ্রামের পুকুর থেকে শিশু ফাতেমা আক্তারের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে নোয়াখালীতে স্কুলে যাওয়ার পথে নবম শ্রেণির এক ছাত্রীকে জোরপূর্বক অপহরণ করে তিন দিন আটকে রেখে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি স্কুল ছুটির পর এই ঘটনা ঘটে। রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকায় নির্যাতনের শিকার এক নারীকে আইনি সহায়তা দেওয়ার কথা বলে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। ভুক্তভোগী এই নারীকে ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়।