Image description

দেশের সর্ববৃহৎ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসা রোগীদের টার্গেট করে পাশেই ঘরে উঠেছে নামে বেনামে অসংখ্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক। এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে রোগীদের জিম্মি করে চলছে রমরমা টেস্ট বাণিজ্য। অভিযোগ রয়েছে ঢাকা মেডিকেলে আসা রোগীদের প্রলোভন দেখিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে মোটা অঙ্কের কমিশন পান দালালরা। শুধু ঢাকা মেডিকেল কেন্দ্রিকই নয়, রাজধানীর বড় সব সরকারি হাসপাতাল ঘিরেই এমন ভুইফোঁড় ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে এনে এসব প্রতিষ্ঠানে ফাঁদে ফেলা হয়। এতে সর্বস্বাস্ত হচ্ছেন সাধারণ রোগী ও তাদের স্বজনরা। এমনকি ভুল রিপোর্ট, ভুয়া চিকিৎসায় সর্বনাশ হচ্ছে অনেক রোগীর। এসব প্রতিষ্ঠানের দেখভালের দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তেমন কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না।

একজন। তার ভাই সাকিল বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নার্স এইখানে তাদের পাঠিয়েছেন। ঢাকা মেডিকেলে নাকি এক্সরে ভালো হয় না। এখানে শুধু তিনি নন সবাই এসেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে। স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে মিরপুরে ভাড়ায় থাকেন মমিনুল। গত বুধবার থেকে তার ভীষণ জ্বর কিছুতেই জ্বর কমছে না। তাই ডাক্তার রক্ত পরীক্ষা দিয়েছেন। রক্ত পরীক্ষা করাতে ট্রান্সফিউশন বিভাগে গিয়েছিলেন। হাসপাতালের এক আনসার বলেছে সরকারি হাসপাতাল তো তাই এইখানে রিপোর্ট ভালো আসে না। আনসার সদস্য বলেছিলেন পিওর ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিপোর্ট ভালো হয়। তাই পিওর ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এসেছেন রক্ত পরীক্ষা করাতে। ঢাকা ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টার থেকে রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে বের হচ্ছিলেন জাহানারা খাতুন। তিনি বলেন, আমি ডাক্তার দেখাতে বহির্বিভাগে আসলে একজন লোক আমাকে দ্রুত টেস্ট করিয়ে দিবে বলে নিয়ে যান। রিপোর্ট নিয়ে আসলে ডাক্তার বলেছেন এ রিপোর্ট চলবে না। শুধু শুধু আমার টাকাগুলো নষ্ট হলো আর সময় গেলো। মানুষকে এভাবে জিম্মি করে দালালরা। আমাদের মতো গ্রাম থেকে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের হয়রানি হতে হয় দালালদের খপ্পরে পড়ে। বলতে বলতে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। পিওর সায়েন্টিফিক ডায়াগনস্টিক লিমিটেডের মালিক ফাহিম বলেন, আমাদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আমরা দক্ষ টেকনিশিয়ান দিয়ে টেস্ট করি। আমাদের এখানে ঢাকা মেডিকেল থেকে বেশি মানসম্মত টেস্ট হয়। ঢাকা মেডিকেলে তো সব টেস্ট করা হয় না। তিনি স্বীকার করে বলেন, আমাদের এক্সরে মেশিন নেই কোনো রোগী আমাদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এক্সরে করতে এলে আমরা পাশের ঢাকা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের এক্সরে মেশিন দিয়ে টেস্ট করি। তিনি আরও বলেন, ঢাকা মেডিকেলে আসা রোগীদের আমরা কোনো দালালের মাধ্যমে আমাদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেস্ট করাতে নিয়ে আসি না। লাইসেন্স সমপর্কে তিনি বলেন, আমরা টেকনিশিয়ান, মেশিন ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সব তথ্য দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স করেছি। ঢাকা ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কন্সাল্টেশন সেন্টারের পরিচালক আমিনুল ইসলাম বলেন, সব ক্লিনিকের কর্তৃপক্ষই দালালের মাধ্যমে ঢাকা মেডিকেলে আসা রোগীদের টেস্ট করাতে ক্লিনিকে নিয়ে আসে। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স পেয়েছি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. মো. নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, বাইরে থেকে যেসব ক্লিনিকের লোকজন মেডিকেলের ভেতরে থাকেন এখানে তাদের থাকার কোনো এখতিয়ার নেই। ঢাকা মেডিকেলেই প্রায় সব ধরনের টেস্ট করানো হয়। নিজেদের স্বার্থে রোগীদের ভুল বুঝিয়ে তারা বাইরে নিয়ে যায়। দালালরা মনগড়া কথা বলে রোগীদের প্রাইভেট ক্লিনিকে নেয়। মেডিকেলেই সব ধরনের ব্যবস্থা আছে। উন্নত যন্ত্রপাতি দিয়ে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, দালালরা যেভাবে রোগী ও স্বজনদের বলে মেডিকেলের চেয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকের টেস্ট ভালো হয়। এই তথ্য সঠিক নয়। ঢাকা মেডিকেলের টেস্ট মানসম্মত হয়। আমাদের টেকনিশিয়ানরা অনেক দক্ষ। ঢাকা মেডিকেলে প্রয়োজনীয় সব টেস্ট করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (হাসপাতাল-১) ডা. সাইদ আবু আহম্মদ সাফি মানবজমিনকে বলেন, আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসলে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। আমাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা ৫ হাজারের বেশি জরিমানা করতে পারি না। পর্যায়ক্রমে আমরা তালিকা যাচাই-বাছাই করে পদক্ষেপ নিচ্ছি এবং যাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম দেখছি তাদের বিরুদ্ধে দ্রুতই ব্যবস্থা নেয়া হবে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান মানবজমিনকে বলেন, আমরা হাসপাতাল বা ক্লিনিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি না। এরকম কোনো অনিয়ম বা সুস্পষ্ট অভিযোগ পেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানাতে পারি। ওদিকে দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করেছে। সম্প্রতি যৌথবাহিনীর দালালবিরোধী অভিযানে ৭০ জন দালালকে আটক করা হয়। তাদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে জরিমানসহ সাজা প্রদান করা হয়েছে। তবে এসব অভিযানের পরও দালাল চক্রের তৎপরতা পুরোপুরি বন্ধ হয় না। কিছুদিন পর এবং কৌশলে ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকদের মাধ্যমে এসব কার্যক্রম চালিয়ে যায় তারা।