
২০১০ সালের শুরুর দিকে, ব্যরিস্টার তাপস হত্যাচেস্টার অভিযোগে, আমরা পাঁচজন সামরিক অফিসার তখন গোয়েন্দা হেফাজতে, কিন্তু আমাদের রাখা হয়েছে- ঢাকা সেনানিবাসে 'অফিসার্স মেস বি' এলাকায়। আমাদেরকে এরেস্টেড অবস্থায় রেখে, চলাচল সীমিত করে দেয়া হয়েছে। আমাদের সাথে সাধারণ অফিসার কেউ সাক্ষাৎ করতে আসে না। কেউ যদি সাহস করে চলে আসে, তার কাছে স্বাভাবিকভাবেই গোয়েন্দা সংস্থা থেকে কারণ জানতে চায়। সিংহভাগ অফিসার এড়িয়ে চললেও, সুহৃদ সিনিয়র কিংবা কোর্সমেট এসে মাঝেসাঝে দেখে যায়।একদিন এক ঘনিষ্ঠ ছোট ভাই সাক্ষাৎ করতে এলো। সে মানসিকভাবে খুব বিপর্যস্ত ছিল। কিছু সময় কথা বলতে চায়। আমাকে খুব মহব্বত করতো। আমি আর ফুয়াদ সেই মেসে একটি কক্ষে থাকি। ডিউটিরত পাহারা অফিসারের অনুমতি নিয়েই শহীদ (ছদ্মনাম- বাস্তবে আমি এখন ওর নাম আর মনে করতে পারি না) আমার সাথে কথা বলতে আসে। ছেলেটা তখন মেজর।
কয়েক মাস আগে ঢাকার রামপুরাতে, সুমন নামের এক ছাত্রদল নেতাকে একটি সংস্থা তুলে নিয়ে আসে। ছেলেটার বিরুদ্ধে তিনটি হত্যা মামলা চলমান বলে জানানো হয়। সুমন দুর্ধর্ষ অপরাধী। কিন্তু গ্রেফতারের পর ভিন্ন চিত্র বের হয়ে আসে। খোঁজ নিতেই জানা যায়, সুমন আসলে ভিন্ন চরিত্র। এই সুমনের নামে থানায় একটি জেনারেল ডায়েরি পর্যন্ত নাই। সে ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে যুক্ত আছে এটা ঠিক। ব্যস এতোটুকুই। সুমনের পরিবারে মা ছাড়া কেউ নাই। মা ডায়াবেটিক রোগী। সুমন মায়ের সেবা করে। ছেলে গ্রেফতার হবার পর মায়ের ক্রন্দনে আকাশ বাতাস মুখরিত। তিনি সম্ভবত একটা ছোটখাটো সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। পত্রিকার সাংবাদিক এবং থানার মারফত নিশ্চিত হওয়া যায়, এটা ভুল মানুষকে গ্রেফতার। কিন্তু সুমনের মুক্তি মিলে না।
এখানেই আমার সেই জুনিয়র অফিসারের কাহিনী যুক্ত।সুমনকে ক্রসফায়ার দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। গোয়েন্দা সংস্থার নেতৃত্বে, পুলিশ, র্যাবের উপস্থিতিতে সুমনকে ক্রসফায়ার দেয়া হবে। গল্প সাজিয়ে সে রাতে সুমনকে একটা গাড়িতে চোখ বেঁধে উঠানো হয়। সুমন ঘটনা উপলব্ধি করে বলেন ,"স্যার, আমার মায়ের দেখভাল করার মতো এই দুনিয়াতে কেউ নাই। আমার মা মরে যাবে স্যার। আমাকে সম্ভব হলে ছেড়ে দেন।"গাড়ি থামে না। সুমন এক পর্যায়ে নিশ্চিত হয়, বাঁচার রাস্তা নাই। সে তখন কুরান তিলওয়াত শুরু করে। উল্লেখ্য, সুমন একজন কুরানে হাফেজ ছিল। নিজেকে শান্ত রাখতে সুমন কুরান তিলওয়াত চালু রাখে। এর মাঝেই এক নির্জন স্থানে গাড়ি থামে। সুমনকে চোখ বেঁধে, পিছনে হাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে গাড়ি থেকে নামানো হয়।একজন পুলিশ অফিসারকে ক্রসফায়ার দিয়ে নির্দেশ দিলে, তিনি তা অমান্য করেন। এরপর আমার সেই অনুজ মেজর সাহেবকে অর্ডার দেয়া হয়। সে নিজেও আদেশ অমান্য করে। কুরান তিলওয়াত করছে এমন একজন মানুষকে খুন করতে ওর আত্মা কেঁপে যায়।
এই সময়ে আরেক অফিসার এগিয়ে আসেন। তিনি বলেন, "স্যার আমাকে দেন।"সুমনকে নিরালায় একটি অজানা স্থানে, মাথায় রিভলভার ঠেকিয়ে, পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে দুই রাউন্ড গুলি করা হয়। দ্বিতীয় গুলির সময়ে সুমনের কণ্ঠে কোন তিলওয়াত শোনা যায় না। কারণ প্রথম গুলি মস্তিস্কে প্রবেশের সাথে সাথে সুমনের কণ্ঠ থেমে গিয়েছিল।সুমনের লাশ তার মায়ের কাছে দেয়া হয় নাই। স*ন্ত্রাসী অমুক তমুক বলে কিছু একটা কাহিনী জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। সুমন খু*ন হবার এক বা দুই মাসের মধ্যেই তাঁর মা পুত্রশোকে দুনিয়া থেকে বিদায় নেন।মেজর সাহেব আমাকে বলছিলেন, "স্যার, সুমনের কুরান তিলওয়াতের কণ্ঠ অদ্ভুত সুন্দর। সেই কণ্ঠ এখনও আমার কানে বাজে। আমি ঘুমাতে পারি না।"ও আমাকে আমার সেই বন্দী দশায় কেন এই ঘটনা বলেছিল, আমি জানতে চাই নাই। হয়তো আত্মগ্লানি থেকে।আমি গুগলে অনেক খুঁজেও এই ঘটনার কোন রেফারেন্স ম্যাটারিয়াল পেলাম না। না কোন পেপার কাটিং। অনেক বছর আগের ঘটনা হবার কারণে হয়তো আর পাওয়া যাচ্ছে না। ঘটনাটি ২০০৯ সালের শুরুর দিকে বা শেষ ভাগের। কারও কাছে সূত্র থাকলে ভেরিফাই করতে পারবেন।
"রাষ্ট্রীয় স্বার্থে" শব্দটি ব্যবহার করে, মে*জর জে*নারেল তারিক সিদ্দিকি অনেক রাক্ষস সৃষ্টি করেছিলেন। এই রাক্ষসদের একমাত্র কাজ ছিল, হা*সিনার স্বৈরশাসনকে সুসংহত করা। এবং এই প্রজেক্ট তাঁদের ক্ষমতা গ্রহনের একেবারে শুরু থেকেই চালু হয়। রাষ্ট্রের সকল বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, সবখানেই এই রাক্ষসদের বিচরন ছিল। এদের অনেকেই স্বেচ্ছায় এগিয়ে যেয়ে আত্মা বিক্রি করেছিল। পার্থিব কিছু প্রাপ্তির লক্ষ্যে এরা আল্লাহ ভীতি বর্জন করে, রক্তের খেলায় মেতে উঠে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ভয়ানক বিচার থেকে এদের যেন কোনদিন মুক্তি না হয়। আল্লাহ যেন এদের প্রত্যেককে দুনিয়া এবং আখিরাতে কঠিন শাস্তি প্রদান করেন।
এই ঘটনা গত ১৭ বছর ধরে আমি কখনও ভুলতে পারি নাই। মনে পড়লেই কষ্ট হয়। খুব জানতে ইচ্ছা করে, সুমনের গলায় তিলওয়াত করা সেই কুরানের আয়াতে, আল্লাহতায়াল তাঁর জন্য এবং খুনিদের জন্য কি বার্তা দিয়েছিলেন।
হয়তো আল্লাহর কাছে সুমন এখন তাঁর অসুস্থ মায়ের সাথে আবার সাক্ষাৎ করেছেন। মায়ের ডায়াবেটিসের সেবা করতে পারেন।
হাসিনা এবং তার দোসরদের বিচার করে আসলে, পাপ আর সমানুপাতিক শাস্তির ভারসাম্য হবে না। এদের পাপ, কুকর্ম, মানুষের জীবন ধ্বংস করে দেয়ার মাত্রা এতো বেশি, এর শাস্তির মাত্রা কি হওয়া উচিৎ- তা বোধ করি দুনিয়ার মানুষের সাধ্যে নির্ধারণ করা সম্ভব না।
রাজীব হোসেন