
রাজধানীর উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের ১৯ নম্বর সড়কে থাকেন চাকরিজীবী তরিকুল ইসলাম। সারা দিন অফিস শেষে বাসায় ফিরেও শান্তি নেই তাঁর। তরিকুল বলেন, চা স্টল থেকে বাসা, কোথাও বসে একটু জিরোবার উপায় নেই। সারাক্ষণ মশার জ্বালাতন। কয়েল, অ্যারোসল, মশা তাড়ানোর বৈদ্যুতিক যন্ত্র কোনো কিছুতে মশা তো কমে না।
উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টর পড়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৬-এর ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে। অঞ্চল-৬ সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. ফিরোজ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বসন্তের এ সময়ে প্রতিবছর কিউলেক্স মশা বাড়ে। এই প্রজাতির মশা ড্রেন, ডোবা, নালা, নর্দমা ও পচা পানিতে জন্মে। রাজধানীর সবচেয়ে বেশি ডোবা, নালা এ অঞ্চলে। তাই স্বাভাবিকভাবে মশাও বেশি জন্মায়।’ তিনি বলেন, চেষ্টা করে যাচ্ছি। ডোবা, নর্দমা, খাল পরিষ্কারের কাজ করছি। ওয়ার্ডে মশকনিধনের জন্য কর্মীদের প্রতিদিন পাঠাচ্ছি। তারা কীটনাশক দিচ্ছে। কিন্তু মশা কমছে না সেভাবে।’
সিটি করপোরেশনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু ঢাকার উত্তরা এলাকায় নয়, রাজধানীজুড়ে মশার উপদ্রব বেড়েছে। বিশেষ করে ঢাকার নিম্নাঞ্চলগুলোতে মশা কিছুতেই কমানো সম্ভবপর হচ্ছে না। এসব এলাকার মধ্যে রয়েছে উত্তরা, দক্ষিণখান, মিরপুর, কামরাঙ্গীর চর, আমিনবাজার, মোহাম্মদপুর, বসিলা, শনির আখড়া, ধোলাইপাড়, কুতুবখালী, কাজলাপাড়, দক্ষিণ কমলাপুর।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির যাত্রাবাড়ী, উত্তর সিটির দক্ষিণখান, উত্তরার দুটি স্থান ও মিরপুর এবং ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাভার ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফাঁদ পেতে মশা পর্যবেক্ষণ করে থাকেন গবেষকরা। এ গবেষণার তথ্য নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ক্রাশ প্রগ্রাম, লার্ভিসাইড বা কীটনাশক প্রয়োগ করে থাকে সিটি করপোরেশনের মশককর্মীরা।
গবেষকদলের প্রধান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার জানান, এ মুহূর্তে তিনি আমেরিকায় অবস্থান করছেন। সেখানকার মসকিউটো কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশন কনফারেন্স শেষে চলতি মাসের মাঝামাঝি দেশে ফিরবেন।
অধ্যাপক কবিরুল বাশার জানান, সম্প্রতি তাঁরা যে গবেষণা করেছেন, এতে দেখা গেছে, উত্তরা ও দক্ষিলখান এলাকায় কিউলেক্স মশার সবচেয়ে বেশি পেয়েছে। পার ম্যান পার আওয়ার শতাধিক। অর্থাত্ একজন মানুষ হাঁটুর ওপর পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় চার শর বেশি মশা কামড়ায়।
শনির আখড়া, মিরপুর, বাংলামোটর, রামপুরা, ভাটারার ছোলমাইদ এসব এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত জানুয়ারি থেকে কিউলেক্স মশার উৎপাত বাড়তে থাকে, যা এখন চরম পর্যায়ে। শনির আখড়া এলাকার বাসিন্দা ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে কালের কণ্ঠের এ প্রতিবেদকের কথা শাহবাগের বটতলায়। চায়ে চুমুক দিতে দিতে তিনি তাঁর এক সহকর্মীকে বলছিলেন বাসায় মশার উৎপাতের কথা।
ইসমাইল হোসেনের সহকর্মী ফখরুল আলম মিরপুর ১২ নম্বর এলাকার বাসিন্দা। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, অন্যান্য বছরে মশকনিধন অভিযান চোখে পড়লেও এবার খুব বেশি পড়ছে না। মাসে দুই-একবার এসে ফগিং করতে দেখা গেলেও এতে মশা কমতে কখনো দেখিনি।
মশকনিধন কার্যক্রম নিয়ে নিজেদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে জানিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, শুধু কীটনাশক ছিটিয়ে মশার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। নিয়মিত ক্রাশ প্রগ্রাম, লার্ভিসাইড বা কীটনাশক প্রয়োগ করা হলেও এটি তেমন কোনো কাজে আসছে না। কারণ এ শহরে ড্রেন, ডোবা, নর্দমা, বিল, ঝিল ও খালে পানির প্রবাহ নেই।
তিনি বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে অনেক ধরনের কমিটি হয়েছে। কারিগরি কমিটি, স্পেশাল ট্রাস্কফোর্স কমিটি, ওয়ার্কিং কমিটি, ওয়ার্ড লেভেল কমিটি, এখন আবার নতুন কীটনাশক গুণাগুণ যাচাইয়ের জন্য কমিটি। এসব কমিটিতে বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন। তাঁরা তাঁদের মতামত দিচ্ছেন, আমরা সেগুলো মেনে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু দিন শেষে মশা কমছে না। কারণ একটি অপরিচ্ছন্ন শহরের কোথাও পানির প্রবাহ নেই।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (অতি. দা.) ডা. নিশাত পারভীন কালের কণ্ঠকে বলেন, বিচ্ছিন্নভাবে কিছু এলাকায় মশার উপদ্রব আছে, বিশেষ করে নিম্ন এলাকাগুলোতে; এটা আমরা জানি। আমাদের চেষ্টাও অব্যাহত আছে। আশা করি সামনে মশার উপদ্রব কমবে।
দক্ষিণ সিটিতে কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে দাবি করেন প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির। তাঁর কাছে গবেষণায় পাওয়া কিছু এলাকার মশার ঘনত্বের উপাত্ত তুলে ধরলে তিনি বলেন, ‘যেমন হাজারীবাগ। এটা নিচু এলাকা। সেখানে ডোবা-নালা আছে।’
অধ্যাপক কবিরুল বাশারের গবেষণাদলের জরিপের ফল ২১ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়েছিল একটি জাতীয় দৈনিকে। তাতে বলা হয়েছিল, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে মশার পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে। বাস্তবেও তা-ই হয়েছে। গবেষক কবিরুল বাশার বলেন, ‘দুই সিটি সেই সময়ে যদি সজাগ হতো, তবে এ মাসে হয়তো মশার উপদ্রব কমত।’
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রতি মাসেই দুই সিটির মশা জরিপের ব্যবস্থা রাখা উচিত। বেশি ঘনত্বের জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।