
জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হতে পারে—এ প্রশ্নের এখনো স্পষ্ট জবাব নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে বলে আসা হচ্ছিল, এ বছর ডিসেম্বর থেকে আগামী বছর জুনের মধ্যে এটি হতে পারে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সে অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসির দক্ষিণ এশীয় প্রতিনিধি সামিরা হুসেইনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে এই নির্বাচন হবে। প্রত্যাশা অনুসারে সংস্কার হলে নির্বাচন হবে ডিসেম্বরে, আর সংস্কারের জন্য বেশি সময় দরকার হলে নির্বাচন হতে আরো কয়েক মাস সময় লাগবে।
আবার প্রায় একই সময়ে স্কাই নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে পারে বলে জানান। এ ছাড়া গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক দুই কূটনীতিক উইলিয়াম বি মাইলাম ও জন ড্যানিলোউইচ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘রাইট টু ফ্রিডম’-এর পক্ষে দেখা করতে গেলে প্রধান উপদেষ্টা তাঁদের বলেন, নির্বাচন চলতি বছরের ডিসেম্বরে অথবা আগামী বছরের জুনে অনুষ্ঠিত হবে। সে হিসাবে আগামী ডিসেম্বর, পরের বছরের মার্চ-এপ্রিল বা জুন—এই তিনটি সময় নিয়েই আলোচনা চলছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছিলেন, এপ্রিল অথবা মার্চে নির্বাচন হতে পারে।
বর্ষার কারণে জুন মাসে নির্বাচন সম্ভব নয়—এই ধারণা প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনেরও। সম্প্রতি নির্বাচন বিটে কর্মরত সাংবাদিকদের এক অনুষ্ঠানে তিনি এই ধারণার কথা জানান।
এর আগে গত ৬ ফেব্রুয়ারি প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচন এ বছরের শেষ নাগাদ, নাকি আগামী বছরের জুনের মধ্যে হবে তা নির্ভর করছে জুলাই চার্টারের ওপর।
কবে নির্বাচন হতে পারে সে সম্পর্কে প্রথম ধারণা পাওয়া যায় গত ২৪ সেপ্টেম্বর। ওই দিন বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ওয়েবসাইটে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্পন্ন করে ১৮ মাস বা দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচনের লক্ষ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারকে যেকোনো পরিস্থিতিতে পূর্ণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
এর পাঁচ মাস পর গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘আমি যতবারই ড. ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেছি, হি কমপ্লিটলি অ্যাগ্রিড উইথ মি, দেয়ার শুড বি ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশন অ্যান্ড দ্যাট ইলেকশন শুড বি উইদিন ডিসেম্বর অর... (আমি যতবারই ড. ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেছি তিনি সম্পূর্ণভাবে আমার সঙ্গে একমত হয়েছেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হওয়া উচিত এবং সেই নির্বাচন হওয়া উচিত ডিসেম্বরের মধ্যে বা...)। যেটি আমি প্রথমেই বলেছিলাম, ১৮ মাসের মধ্যে একটি ইলেকশন। আমার মনে হয়, সরকার সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে।’
ডিসেম্বরে নির্বাচনের সম্ভাবনা যেসব কারণে কমছে : এদিকে চলতি বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনা ক্রমেই কমছে বলে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের ধারণা। তাঁদের বক্তব্য, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত না হওয়ায় নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক সব কাজ এখনো শুরু করা যায়নি। বিশেষ করে নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও বিদ্যমান নিবন্ধিত দলগুলোর হালনাগাদ অবস্থা পরীক্ষণ—এসব কাজ সম্পন্ন করতে যথেষ্ট সময় দরকার। কিন্তু এই কাজগুলো কবে শুরু হবে তা এখনো বলতে পারছে না নির্বাচন কমিশন। এ ছাড়া এ বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রমে প্রায় ২০ লাখ সম্ভাব্য নতুন ভোটারের তথ্য সংগ্রহ করার বিষয়টি কিছুটা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ভোটার তালিকা আইন অনুসারে এসব সম্ভাব্য ভোটার ২০২৬ সালের ২ মার্চ চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পাবেন। তবে নির্বাচন কমিশন বলে আসছে, প্রয়োজনে আইন সংস্কার করে নতুন ভোটারদের তালিকাভুক্তির কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা যেতে পারে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সম্প্রতি বলেছেন, আগামী জুনে এই কাজ সম্পন্ন করা যেতে পারে।
নির্বাচন কমিশন গত ২০ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রমে যে ৪৯ লাখ ৭৬ হাজার ৮৪৫ জন বাদ পড়া ও নতুন ভোটারের তথ্য সংগ্রহ করেছে, তার মধ্যে নতুন ভোটার ১৮ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৬ জন। তাঁদের জন্ম ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি বা এর আগে। তাঁরা ২০২৬ সালের ভোটার তালিকায় স্থান পাবেন। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁদের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। কারণ এবারও অনেকের তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি বা তথ্য সংগ্রহকারীরা সব ক্ষেত্রে বাড়ি বাড়ি যাননি বলে অভিযোগ উঠেছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা ছাড়াও নির্বাচনী আসনগুলোর সীমানা পুনর্নির্ধারণ করার বিধান রয়েছে। এ জন্য নীতিমালা প্রস্তুত ও গেজেট প্রকাশ, জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস) প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পুনর্নির্ধারিত সীমানার খসড়া তালিকা প্রণয়ন ও প্রকাশ করে দাবি, আপত্তি, সুপারিশ আহ্বান ও শুনানি শেষে নিষ্পত্তি করা এবং চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের জন্য যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন এই কাজে প্রায় ছয় মাস সময় নিয়েছিল। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ রয়েছে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগকে সুবিধা দিতে ১৩০ আসনের সীমানায় পরিবর্তন আনা হয়েছিল এবং তা আজও বহাল আছে। ওই সময় যে আসনগুলোতে বিএনপির জনপ্রিয়তা ছিল সেগুলো কর্তন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। সে কারণে এবার সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন জানান, সীমানা পুনর্নির্ধারণের জন্য আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। কাজটি দ্রুত শুরু করতে হবে। এরই মধ্যে সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে ৫০টির বেশি আবেদন জমা পড়েছে।
নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন এবং বিদ্যমান নিবন্ধিত দলের বর্তমান অবস্থা পরীক্ষা করে দেখাও নির্বাচন কমিশনের অন্যতম কাজ। আগের নির্বাচন কমিশন এই কাজে প্রায় আট মাস সময় নিয়েছিল।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করতে হলে অক্টোবরের মধ্যেই সব প্রস্তুতি শেষ করতে হবে। তফসিলের আগে ভোটার তালিকা প্রস্তুত, নতুন দলের নিবন্ধন ও সীমানা পুনর্নির্ধারণ ছাড়াও পর্যবেক্ষক নীতিমালা প্রণয়ন, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ, নির্বাচনী মালপত্র ক্রয়—এসব করতে নির্বাচন কমিশনের অনেক সময় প্রয়োজন। কিন্তু নির্বাচন বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের যোগাযোগ, সহযোগিতায় এখনো তেমন গতি নেই। সরকার ও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতেই জাতীয় নির্বাচন সম্ভব। আগে চারটি জাতীয় নির্বাচন ডিসেম্বর-জানুয়ারিতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো যা বলছে : দেশের প্রধানতম রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো ন্যূনতম সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে। গত শুক্রবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চট্টগ্রামে জন্মাষ্টমী উদযাপন অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে বলেন, ‘স্বৈরাচারের পতন হলেও ষড়যন্ত্র থেমে নেই। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে জনগণের সরকার যতক্ষণ প্রতিষ্ঠিত না হচ্ছে, ততক্ষণ গণতন্ত্র নিরাপদ নয়।’
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার পদ ছেড়ে সদ্যোগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রধান হিসেবে যোগ দেওয়া নাহিদ ইসলাম গতকাল বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও পুলিশের কার্যক্রমের অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আমি মনে করি না যে জাতীয় নির্বাচন এখন সম্ভব।’
জামায়াতে ইসলামী সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন চায়। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আমাদের অবস্থান অপরিবর্তিত আছে। প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া কোনো নির্বাচন নয়। সরকার যদি মনে করে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।’
বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাসদ (মার্ক্সবাদী) নেতা মাসুদ রানা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে—প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া ওই ঘোষণায় আমরা আস্থা রাখতে চাই। ওই ঘোষণার আলোকে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও নির্বাচনী প্রস্তুতি একই সঙ্গে গ্রহণ করা হবে বলে আশা করি। তা না হলে জনজীবনে সংকট আরো বাড়বে।’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা আকবর খান। তিনি বলেন, নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, এখন দিন-তারিখ ঘোষণা দরকার। নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনও প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছে। জনগণও দীর্ঘদিন ভোট দিতে পারেনি, তারাও অপেক্ষা করছে। তাই নির্বাচন নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।