
দেশের সার সরবরাহ নিশ্চিত করে উৎপাদন ধরে রাখতে বেশ শক্ত অবস্থানে অন্তর্বর্তী সরকার। ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইটিএফসি) সঙ্গে সই হওয়া ঋণ অর্থায়ন পরিকল্পনায় সারের বিষয়টি রয়েছে। এখন সার আমদানির জন্য এই ঋণ নিতে দ্বিধা সৃষ্টি হয়েছে। এতে উচ্চ সুদ বা মুনাফার কারণে স্থানীয় ব্যাংকঋণের চেয়ে ব্যয় বেশি হবে। আবার এই ঋণ না নিলে ডলার ঘাটতি ও ভর্তুকি ব্যয়ের চাপ বাড়বে।
এ বিষয় নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পত্রবিনিময় চলছে। এখন এই ঋণ না নিলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) কী করবে, এ নিয়ে আলোচনা চলছে। বিদেশি ঋণের ডলার সুবিধা মিললেও সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। সুদের হারও তুলনামূলক বেশি হবে। অন্যদিকে দেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সরকারের ভর্তুকির চাপ বাড়তে থাকবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দেশে সার আমদানি নিশ্চিত করতে অর্থের জোগান দিতে হবে। এ জন্য কৃষি ও শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ আইটিএফসি থেকে ঋণ নেওয়ার উদ্যোগ নেয়।
কিন্তু আইটিএফসির ঋণ নিয়ে সার আমদানি করা হলে ব্যয় তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পাবে এবং এর ফলে ভর্তুকির পরিমাণও বাড়বে বলে মনে করছে বিএডিসি ও বিসিআইসি। এ অবস্থায় সার আমদানির জন্য আইটিএফসির ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণের প্রস্তাব আটকে আছে।
জানা গেছে, দেশে প্রতিবছর সারের মোট চাহিদা প্রায় ৬০ লাখ মেট্রিক টন। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ না থাকায় দেশে বিদ্যমান সার কারখানাগুলোর মাধ্যমে এই চাহিদার অতি সামান্য অংশই উৎপাদন করা হচ্ছে। ঘাটতি থাকা সার সরকারি পর্যায়ে বিসিআইসি ও বিএডিসির মাধ্যমে এবং বেসরকারি আমদানিকারকদের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর জ্বালানি ও সার খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়ে আইটিএফসি ও বাংলাদেশ সরকারের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল সৌদি আরবের জেদ্দায় একটি সভা করে। ওই সভায় আইটিএফসি থেকে জ্বালানি ও সার খাতে মোট ২.৭৫ বিলিয়ন ডলারের স্বল্পমেয়াদি ঋণ গ্রহণের বিষয়ে উভয় পক্ষ প্রাথমিকভাবে সম্মত হয়ে বার্ষিক অর্থায়ন পরিকল্পনা সই করে। এই ঋণের মধ্যে ১.৬৫ বিলিয়ন পেট্রোলিয়াম পণ্য, ৬০০ মিলিয়ন এলএনজি এবং সার আমদানির জন্য ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ আছে। সার খাতে এই ঋণের মধ্যে ২০০ মিলিয়ন ডলার কনফার্মড ঋণ এবং অবশিষ্ট ৩০০ মিলিয়ন ডলার কন্টিনজেন্সি ঋণ। যেহেতু ঋণটি অনমনীয় প্রকৃতির, তাই এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অধীন নন-কনসেশনাল লোন কমিটির অনুমোদন প্রয়োজন হবে।
এই ঋণচুক্তি সই হলে প্রতিটি ঋণপত্রের (এলসি) বিপরীতে সার আমদানি মূল্য আইটিএফসি থেকে তাত্ক্ষণিক ডলারে পরিশোধ করা হবে। এভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় যথাসময়ে রপ্তানিকারকদের বিল পরিশোধিত হলে সার আমদানির ক্ষেত্রে শিডিউল বা এলসি বিপর্যয়ের আশঙ্কা দূরীভূত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এলসি স্থাপনকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ডলারের ওপর তাত্ক্ষণিক চাপ হ্রাস পাবে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে টেকসই সার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা যাবে। এই লক্ষ্যে প্রথম পর্যায়ে সীমিত আকারে আইটিএফসির ঋণ কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি জেদ্দায় অনুষ্ঠিত সভায় প্রাথমিকভাবে কার্যবিবরণীভুক্ত হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব সই করেছেন। এখন অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সার আমদানির জন্য আইটিএফসি থেকে আর্থিক সহায়তা (ঋণ) নেওয়ার বিষয়ে মতামত দেওয়ার জন্য বলা হয়।
তবে এই ঋণ গ্রহণের বিষয়ে বিএডিসি ও বিসিআইসি নেতিবাচক মত দিয়েছে। সংস্থাগুলো তাদের চিঠিতে তুলে ধরেছে, আইটিএফসি ঋণের সম্ভাব্য সুদের হার ১৮.৫৩ শতাংশ হবে, যা স্থানীয় ব্যাংকের সুদের হারের চেয়ে অনেক বেশি। এ প্রেক্ষাপটে বিএডিসি ও বিসিআইসি আইটিএফসি থেকে বর্তমানে কোনো ঋণ গ্রহণ না করার জন্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছে।
সংস্থাগুলো আরো জানিয়েছে, আইটিএফসির প্রস্তাবিত ঋণের শর্তানুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে হবে। আইটিএফসি ঋণের বার্ষিক মার্কআপ বা মুনাফার হার অপাতদৃষ্টিতে ৬.৪৩৭ শতাংশ হলেও প্রকৃতপক্ষে ওই ঋণের শর্তানুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে হলে অর্থ বিভাগ থেকে যথাসময়ে ভর্তুকির অর্থপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের এলটিআর ঋণের সুদের হায় ১২.৫০ থেকে ১৩.০০ শতাংশ, যা আইটিএফসির প্রস্তাবিত ঋণের সম্ভাব্য ব্যয়ের তুলনায় কম হবে। এ অবস্থায় আইটিএফসি থেকে ঋণ নিয়ে সার আমদানি করা হলে ব্যয় তুলনামূলকভাবে বাড়বে। এর ফলে ভর্তুকির পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে বলে মতামত দিয়েছে বিএডিসি।
অর্থ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোকে জানিয়েছে, এই ঋণের ব্যবস্থাপনা ও দায় পরিশোধ মূলত বিসিআইসি ও বিএডিসিকে করতে হবে। সে ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের মতামতের আগে বিসিআইসি ও বিএডিসি থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে নিঃশর্ত সম্মতি থাকতে হবে।
এ অবস্থায় আইটিএফসি থেকে সার আমদানির লক্ষ্যে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের মতামত দেওয়ার সুবিধার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। বিশেষ করে বিসিআইসির মতামতে ফান্ড হোল্ডিং কস্ট ৩.২৫ শতাংশ এবং ডলার এক্সচেঞ্জ ফ্ল্যাকচুয়েশন লস ৮.৮৫ শতাংশ কিভাবে ঋণের সুদ ব্যয় ১৮.৫৩ শতাংশ ধার্য করা হয়েছে। এই ব্যয় ধরার ভিত্তি কী তা অর্থ বিভাগকে অবহিত করার জন্য বলা হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে আইটিএফসিকে অর্থায়নের প্রস্তাব দেওয়া হয়। ওই প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে আইটিএফসি। কিন্তু বিসিআইসি ও বিএডিসি আইটিএফসি থেকে ঋণ নিতে আগ্রহী নয়। এ অবস্থায় বিদেশি এই ঋণ গ্রহণ করার যৌক্তিকতা রয়েছে কি না তা কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চাইবে অর্থ মন্ত্রণালয়। আবার আইটিএফসির ঋণ না নিয়ে সার আমদানির জন্য বিসিআইসি ও বিএডিসি অন্য কোনো উৎস থেকে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারবে। এর সঠিক পরিকল্পনা সুস্পষ্টভাবে জানতে চাইবে অর্থ মন্ত্রণালয়।