Image description
রাজনীতি

সদ্য আত্মপ্রকাশ করা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) লক্ষ্য দেশে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করা। তবে এই ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ও ‘গণপরিষদ নির্বাচন’ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে বিতর্ক। ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের মধ্যেও এ নিয়ে রয়েছে ভিন্নমত। তা ছাড়া সেকেন্ড রিপাবলিক বলতে প্রকৃতপক্ষে ছাত্ররা কী বোঝাতে চাইছেন, সেটিও অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। বিএনপিসহ অধিকাংশ সমমনা দলের অভিমত, ফার্স্ট রিপাবলিক যখন অকার্যকর প্রমাণিত হবে, কেবল তখনই সেকেন্ড রিপাবলিকের বিষয়টি আসবে। ফার্স্ট রিপাবলিককে তো কেউ নেগলেট (অবজ্ঞা) করেনি। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ফলে বর্তমানে সেকেন্ড রিপাবলিকের কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। তবে দু-একটি দল বলছে, আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার স্বপ্নকে দুমড়েমুচড়ে ব্যর্থ করে দিয়েছে। এমন অবস্থায় সার্বিক বিবেচনায় সেকেন্ড রিপাবলিকই হতে পারে নতুন পলিটিক্যাল সেটেলমেন্টের (বন্দোবস্ত) সমাধান। তবে এটার জন্য দরকার জাতীয় ঐকমত্য।

গত শুক্রবার আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে এনসিপির ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘আমরা মনে করি, জুলাই-২০২৪ গণঅভ্যুত্থান আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াই সূচনা করেছে। একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদের সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সব সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে। সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় গড়ে তোলা এবং তাদের গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে আমাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার। এর মধ্য দিয়েই কেবল আমরা একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারবে।’

এনসিপি ঘোষিত ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ও ‘গণপরিষদ নির্বাচন’ নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে না বিএনপি। দলটি মনে করছে, এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। কারণ, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এর একটি সংবিধান রয়েছে। এই সংবিধানের আলোকেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিয়েছে। তবে বিগত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে একে দলীয়করণ করে গণতন্ত্রের বিপক্ষে এবং নিজেদের পক্ষে সাজিয়েছিলেন। সেজন্য সংবিধানের সংস্কার দরকার।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এনসিপি সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠায় গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়নের কথা বলেছে। এটা তাদের অন্যতম লক্ষ্য বলেছে। নতুন বন্ধুদের বলতে চাই, আমাদের বর্তমান রিপাবলিক কি অসুস্থ হয়ে গেছে? সেকেন্ড রিপাবলিক কখন হয়? রিপাবলিক হচ্ছে, যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন, তাদের একটা নমিন্যাল অথবা ইলেকটেড হেড অব দ্য স্টেট থাকবে। সেটা কি আমাদের নেই? গণপরিষদ কেন হবে? এর মধ্যে তো আরও একটি উদ্দেশ্য আছে। যারা গণপরিষদের বিষয় সামনে আনছে, যারা সেকেন্ড রিপাবলিকের বিষয় সামনে আনছে, হয় তারা বোঝে না অথবা বুঝেও আমাদের এই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আরও দীর্ঘায়িত অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র করছে।

তিনি আরও বলেন, যে সময়ে দেশে কোনো সংবিধান রচিত থাকে না, মানে একটা নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, তখন গণপরিষদের প্রয়োজন হয়। গণপরিষদের সদস্যরা সংবিধান প্রণয়ন করেন, যে সংবিধানের ভিত্তিতে পরে সংসদ নির্বাচন হয়। আমাদের এখানে গণপরিষদ নির্বাচনের জন্য আমরা কি নতুনভাবে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি? রাষ্ট্র তো স্বাধীন আছে। আমরা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।

সালাউদ্দিন আহমেদের ভাষ্য—আমাদের যেভাবেই হোক একটা সংবিধান আছে। যে সংবিধানকে এখন পুরোপুরি গ্রহণ করি না বলে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। যে সংবিধানকে শেখ হাসিনা দলীয়করণ করে গণতন্ত্রের বিপক্ষে নিজেদের পক্ষে সাজিয়েছিলেন। সে জন্য সেটার সংস্কার দরকার।

বিএনপির নেতাকর্মীদের উদ্দেশে গত রোববার এক অনুষ্ঠানে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘এখন নতুন দল এসেছে, আপনারা সাবধান থাকবেন। আমি কিন্তু তাদের স্লোগান বুঝি না। আমি কিন্তু বুঝি নাই কাকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে। আমি এখনো বুঝি নাই সেকেন্ড রিপাবলিক কী। কী বোঝায়, আপনারা বুঝেছেন কি না, জানি না? অর্থাৎ একটা অছিলা ধরে জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে। দয়া করে খেয়াল রাখবেন।’

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী বলছে, নতুন দলের নতুন কর্মসূচি, নতুন ধারণা থাকতেই পারে। এটা গণতন্ত্রের একটা সৌন্দর্য। এ প্রসঙ্গে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার কালবেলাকে বলেন, একটি নতুন দলের নতুন কর্মসূচি, নতুন রাজনৈতিক ধারণা থাকতেই পারে। নতুন কিছু দেওয়ার অধিকার তাদের আছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রকাঠামো, রাষ্ট্র ব্যবস্থা, পার্লামেন্ট, এককক্ষ, দ্বিকক্ষ, গণপরিষদ কিংবা সংবিধান রক্ষা করা, সংশোধন করা, বাতিল করা, এমন নানান মত নানা দলের আছে। এটা গণতন্ত্রের একটা সৌন্দর্য। এ ব্যাপারে নিজ নিজ দল তাদের প্রস্তাবের ব্যাখ্যা দিতে পারে এবং এটাই সমীচীন। একটা দল এটা কেন দিল, এটা ঠিক কি বেঠিক, সেটা নিয়ে অন্য আরেকটি দলের মন্তব্য করাটা উচিত নয়।

তিনি আরও বলেন, গণতান্ত্রিকভাবে মুক্ত চিন্তা, স্বাধীন রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের সুযোগ বর্তমানে এ দেশে রয়েছে। ছাত্ররা সেকেন্ড রিপাবলিক এবং গণপরিষদের কথা বলেছে, এর ব্যাখ্যা তারা দেবে। এ নিয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করতে চাই না। আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে সরকারকে সংস্কার (রিফর্ম) প্রস্তাব দিয়েছি।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ফার্স্ট রিপাবলিক যখন কার্যকর নয় বলে প্রমাণিত হবে, কেবল তখনই সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা আসবে। আমাদের ফার্স্ট রিপাবলিক যেটা আছে, সেটাকে তো কেউ নেগলেট করেনি। সংবিধান সংস্কার কমিশন যেটা আছে, সে অনুযায়ী সংবিধানকে সংশোধন করে আমাদের এগোতে হবে। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের কথা শুনলে, এই কনস্টিটিউশন (সংবিধান) তো ভেঙে দিতে হবে। তার পরই বিতর্ক লাগবে যে, ইসলামিক কনস্টিটিউশন হবে নাকি সেক্যুলার কনস্টিটিউশন হবে, রাষ্ট্রধর্ম থাকবে নাকি থাকবে না, তখন সেই বিতর্ককে সমাধান করবে। আমরা সেকেন্ড রিপাবলিক ও গণপরিষদকে সমর্থন করি না।

তিনি আরও বলেন, ছাত্ররা বলছে, ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ফার্স্ট রিপাবলিক ও এই কনস্টিটিউশন রেখেই শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল করেছেন। আবার এই কনস্টিটিউশন রেখে বেগম খালেদা জিয়া দেশ পরিচালনা করেছেন, তখন তো ফ্যাসিজমের অভিযোগ ওঠেনি। কনস্টিটিউশন ভালো লেখা হলেই যে আর ফ্যাসিজম আসতে পারবে না, সেটা ঠিক নয়। সবচেয়ে ভালো কনস্টিটিউশন হলেও তো মার্শাল ল আসতে পারে।

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু কালবেলাকে বলেন, ২০১৯ সালে দল গঠনের আগে আমরা একটি প্ল্যাটফর্ম ঘোষণা করি, যার নাম ছিল ‘জনআকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’। সেই প্ল্যাটফর্মের ঘোষণাপত্রে আমরা সেকেন্ড রিপাবলিকের দাবি তুলেছিলাম। এ ছাড়া নতুন প্রজন্মের আরও অনেক রাজনৈতিক দল থেকেও এ দাবি তোলা হয়। আমরা স্পষ্টত মনে করি, আমাদের প্রথম রিপাবলিক ফেইল করেছে। যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, আওয়ামী লীগ সে স্বপ্নকে দুমড়েমুচড়ে ব্যর্থ করে দিয়েছে। সুতরাং এখন সার্বিক বিবেচনায় দ্বিতীয় রিপাবলিকই হতে পারে নতুন পলিটিক্যাল সেটেলমেন্টের সমাধান। তবে এটার জন্য দরকার জাতীয় ঐকমত্য, যদিও সেই জাতীয় ঐকমত্যের পথটা অনেক জটিল ও কঠিন বলে মনে হচ্ছে।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে কতিপয় ছাত্রের উচ্চাবিলাসী এবং হঠকারী চিন্তা-ভাবনায় গত ছয় মাসে দেশে নতুন নতুন বেশ কিছু সংকট তৈরি হয়েছে। সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। কিছু হঠকারী প্রস্তাবনাও তারা নিয়ে এসেছে। যেটি রাজনীতিতে বিভাজন তৈরি করেছে, ৫ আগস্টকেন্দ্রিক যে জাতীয় ঐক্য ছিল, তাতেও ফাটল ধরিয়েছে। এখন সেকেন্ড রিপাবলিক বলতে কী বোঝায়, তারা কী বোঝে, সেটা পরিষ্কার জানি না। এর আগে তারা রাষ্ট্রপতিকে সরাতে চেয়েছে, সংবিধান বাতিলের দাবি জানিয়েছে—যেটাতে আমরা রাজনৈতিক দলগুলো সমর্থন দিইনি। গুটি কয়েক ব্যক্তি চাইলে তো আর অনেক কিছু হবে না। কারণ, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিটাও তো আর আগস্টের মতো নেই।